বাংলাদেশের চলতি সমাজ ধর্ষক উৎপাদনের কারখানা!

বাংলাদেশের চলতি সমাজ ধর্ষক উৎপাদনের কারখানা!

প্রতীকী ছবিঃ সংগৃহীত

ফজলুল বারী :ধর্ষন নিয়ে বাংলাদেশে এখন খুব মাতামাতি হচ্ছে। তবে আমার ধারনা ধর্ষন হঠাৎ বেড়ে যায়নি। প্রকাশটা বেড়েছে। আগেও ধর্ষন হতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষিতা বা পরিবারগুলো তা চেপে যেতো। কারন বাংলাদেশের আইন ধর্ষিতার প্রতি মানবিক নয়। ধর্ষিতাকেই প্রমান করতে হয় সে ধর্ষিত হয়েছে। এরপরও এখন ধর্ষিতা, পরিবারগুলো তুলনামূলক প্রতিবাদী হয়ে ওঠায় এর অনেক ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঘটছে নুসরাতের মতো মর্মন্তুদ ঘটনাও।
এখনকার ধর্ষকের ভেতরটা বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। তার মেয়ে আছে, বোন আছে, প্রেমিকা অথবা স্ত্রীও আছে। কিন্তু চান্সে সে আরেক মেয়েকে ভোগ করার মওকা খোঁজে। সে পুরুষ অথবা যুবক রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বিচারক, পুলিশ বা সেনাসদস্য যেই হোকনা কেনো। তিরিশ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের নেত্রী নারী। কিন্তু এরজন্যে এ দলদুটির নেতাকর্মীর মধ্যে নারীর প্রতি সেভাবে শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠেনি। এদের বেশিরভাগের শুধু যার যার নেত্রীর সামনে গেলে হাঁটু কাঁপে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তাদের অনেকে চান্স খোঁজে কোথায় কোন মেয়েটা এভেইলেবল।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এই রোগটা বেশি হবার কারন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা আইনের ফাঁকফোঁকরে নিজেদের বাঁচাতে পারে। নুসরাতের মতো হৈচৈ ফেলা ঘটনার পর আসামীদের ধরা হলেও জনে জনে জিজ্ঞেস করে দেখুন, খুব কম মানুষ বিশ্বাস করে এই ঘটনার বিচার হবে। যে দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিটি বড় রাজনৈতিক ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছে যে দল সে দলটি আজ ধর্ষকের মতো বাজে লোকজনের আশ্রয়স্থল কেনো হয়েছে? উত্তর একটাই, বাংলাদেশের আর সব দলের মতো এ দলটির কোন স্তরেই এখন রাজনৈতিক চর্চা নেই।
অনলাইনের কারনেও আপনি আপনার আশেপাশের অনেক ধর্ষকামীকে চিনতে পারবেন! বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার ইউটিউব লাইভের পেজে একটু ডু মারুন। ১৮-২০ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ সমর্থক ছেলে খালেদা জিয়াকে, একই বয়সী বিএনপি বা আওয়ামী বিরোধী ছেলেরা শেখ হাসিনাকে ধর্ষনের আগ্রহ পোষন করে মন্তব্য লিখছে! যারা এভাবে অবিশ্বাস্যভাবে লিখতে পারে সুযোগ পেলেও এরা ধর্ষনও করতে পারবে। অথবা করে।
নারায়নগঞ্জের টানবাজার, ঢাকার কান্দুপট্টি পতিতালয় উচ্ছেদের সময় একজন রিপোর্টার হিসাবে অনেক যৌনকর্মীর ইন্টারভ্যু করতে গিয়ে অবাক যে গল্পটি পেয়েছি তাহলো এসব যৌনকর্মীর জীবনটা শুরু হয়েছিল কোন একজন পুরুষের লালসার স্বীকার হয়ে। এখনতো সেই ধর্ষক পুরুষেরা ব্ল্যাকমেইলিং এর জন্যে ছবিও তুলে রাখে। এমন অনেক পতিতাপল্লী উচ্ছেদের মাধ্যমে এলাকার এলাকার আবাসিক হোটেলগুলোয় যৌনকর্মীদের ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে এক সময় মনে করা হতো ধর্মীয় চর্চার মাধ্যমে ধর্ষনের মতো অপরাধকে নিয়ন্ত্রন সম্ভব। কিন্তু এখনতো প্রকাশ পাচ্ছে ধর্মীয় নেতারাও ধর্ষকামী। নারী-পুরুষ কিছুতেই তাদের বাছবিচার নেই! এর অন্যতম কারন প্রচলিত সব ধর্মই পুরুষতান্ত্রিক। ভোগবাদী। নারীকে ভোগের নানা ফতোয়া, ফন্দি ফিকির এদের মুখস্ত। ওয়াজি মাওলানা হিসাবে এক সময় তুমুল জনপ্রিয়, এখন যুদ্ধাপরাধী হিসাবে যাবজ্জীবন কারাবাসী দেলোয়ার হোসেন সাঈদির ‘সোনা পাখি, ময়না পাখি’, ‘লইট্যা ফিশ’, ‘মেশিনম্যান’ জাতীয় ফোনালাপের নানান অডিও টেপতো অনলাইনে আছে।
ধর্ষকামী এরশাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি এখনও দেশের অন্যতম রাজনৈতিক চরিত্র। এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতাসীন হলে এর খন্দকার মোশাররফ সহ আরও কতিপয় নেতারা ছাত্রদলের তদবিরবাজ মেয়েকর্মীদের কিভাবে ভোগ করতেন তা ওয়াকিফহালরা জানেন। আবার ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এর ধর্ষকামী তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক সায়ীদকে মেয়ে সাপ্লাই দিয়ে টেলিভিশনে চাকরি নেয়া সাংবাদিকদের কেউ কেউ এখন ইউনিয়নের নেতৃত্বেও আছেন। ধর্ষকামী নেতাদের সবার চরিত্র প্রকাশ্যে ফুলের মতো পবিত্র হলেও ভিতরটা তেমন অন্ধকার।
বাংলাদেশের প্রচলিত সমাজও ধর্ষকামী উৎপাদনের কারখানা। এটা শুধু বাংলাদেশ নয় যে সমাজ যত বেশি রক্ষনশীল, এর ভেতরটা তত অন্ধকার। বাংলাদেশে যেটি প্রেম, অস্ট্রেলিয়ায় সেটি বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড। এখানে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড পরষ্পরের বাসায় গিয়ে থাকে। বাবা-মা’ও বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসাবে দেখেন। বয়ফ্রেন্ড জানে তার সেক্স হবে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে। গার্লফ্রেন্ডও জানে তাই। এর বাইরে এখানে এক ছেলে আরেক মেয়ের দিকে তাকায়ওনা। এরজন্যে এরা ধর্ষকামীও হয়না। কিন্তু বাংলাদেশের ‘পবিত্র সমাজ’ এটি অনুমোদন করবেনা। এখানে ধর্ষকামী তৈরির কারখানাটিও সক্রিয় থাকবে।

ফজলুল বারী