আমাদের পিতাকে হত্যাকারী জিয়া-খালেদাকে আমরা চিনি

আমাদের পিতাকে হত্যাকারী জিয়া-খালেদাকে আমরা চিনি

ফজলুল বারী: ১৫ আগষ্ট। বাঙালি জাতির ললাটের শোকের কালো হরফের দিন। লজ্জার দিন। এদিন বাঙালি জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়। খবরটা জানার পর স্তব্দ হয়ে যায় সারা বিশ্ব। কারন একাত্তরে সারা পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন তুলে যে একজন নেতার নামে ও নেতৃত্বে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করলো, সেই নেতা হয়ে উঠলেন সে জাতির পিতা। তাকেই হত্যা করা হলো সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের ষড়যন্ত্রে! বড় কোন প্রতিবাদ হলোনা। মাওলানা ভাসানী, জেনারেল ওসমানীর মতো ব্যক্তিত্বও এর বিরুদ্ধে টু শব্দটি প র্যন্ত করলেননা। বরঞ্চ খুনিদের পক্ষ নিলেন! তিন বাহিনীর প্রধানকে বলা হলো অস্ত্রের মুখে পক্ষে আনা হয়েছে। জিয়াউর রহমান সেভ করতে করতে বললেন সাংবিধানিক ভাবে নতুন একটি সরকার শপথ নেবে। এর সবকিছু পরবর্তিতে আরও স্পষ্ট হয়। কারন এই খুনের আল্টিমেট উপকৃত ব্যক্তিটির নামর  জিয়া।

তার নেতৃত্বে জাতির জনকের কফিনের ওপর দাঁড়িয়ে পরবর্তিতে বিএনপির জন্ম। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সংসদে অর্ডিনেন্স পাশ করে বলা হয় এই খুনের বিচার করা যাবেনা। খুনিদের ইনডেমনিটি দেয়া হয় সেই অর্ডনেন্সে। এটা কে করেছে? জিয়া। খালেদা জিয়া ক্ষমতা পেয়ে এই বিচার আটকে দেন। কী স্বার্থ তার? এটা কী বঙ্গবন্ধুর তার সংসার রক্ষার পুরস্কার? এই মহিলা শুধু অকৃতজ্ঞই না। কৃতঘ্নও। সবকিছুরই প্রকৃতির একটি বিচার থাকে। সে কারনে তিনি এখন হুইল চেয়ার চড়েন। তার বিশাল দল তার মুক্তির জন্যে দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করে কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট দেখুন। আমেরিকা-চীন-ব্রিটেন-ইউরোপ, সৌদি আরব সহ আমেরিকার দালাল সব রাষ্ট্রের অনিচ্ছা এবং বিরোধিতার মুখে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ যেন কতবড় বেয়াদবি! বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় আমেরিকা-ব্রিটেন সহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু চীন-সৌদি আরবের মতো দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। কতবড় ক্রোধ। একাত্তরের প্রতিশোধ নিতে  এরা ভিতরে ভিতরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের জোগাড় করেছে। এর আগে দূর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে দেশে। যাতে মানুষ বঙ্গবন্ধুর ওপর ক্ষিপ্ত থাকে। আবার দূর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়ে গেছে দেখে বঙ্গবন্ধুকে খুনেও দেরি করেনি।

বঙ্গবন্ধুকে খুনের রাতে সবার আগে খুনিদের সমর্থন জানালো পাকিস্তান। খাদ্য সহ অর্থনৈতিক সাহায্য ঘোষনা করলো। চীন-সৌদি আরব এসব দেশ স্বীকৃতি দিলো বাংলাদেশকে। আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে? দালাল রাজাকার-আল বদর-আল শামসের বাইরেও দেশের ভিতরের বিস্তর লোকজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলো। মোল্লা-মৌলভী-ধর্মীয় নেতাদের বড় অংশ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। তাদের প্রানের দেশ পেয়ারা পাকিস্তান।  কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে দেখে এদেরও অনেকে জয়বাংলা বলে মাঠে নেমে যায়। এমন অনেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্র হাতে তখন নকল মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে। এদের কেউ কেউ জাসদ গঠনের পর, বাকিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বরূপে ফিরে যায়। সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল আমাকে এক ইন্টারভ্যুতে বলেছিলেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর যারা বিজয় দেখেনি তারা সবাই রাজাকার।‘ বিচিন্তার জন্যে ইন্টারভ্যুটি নিয়েছিলাম। আসার সময় মুকুল ভাই হাত ধরে বলেন খাসা একটা হেডিং দিয়া দিলাম। ১০ হাজার কপি বেশি ছাপতে দেবা।

বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর খুনিদের কত আত্মপক্ষ! বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের হাতে আত্মসমর্পন করেছেন, জিয়াউর রহমান ঘোষনা না দিলে দেশ স্বাধীন হতোনা, ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুকে খুনের পর খুনিরা যা বলতো তা এখন লন্ডনে বসে বলে তারেক রহমান। কিন্তু অর্বাচীনরা জানেনা কোন একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ একদিনে গড়ে ওঠেনা বা শুরু হয়না। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের শুরু সেই আটচল্লিশে। যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পায়তারা দেখান জিন্নাহ। এর পুরো প্রক্রিয়ার নেতা বঙ্গবন্ধু।

সেই আটচল্লিশ থেকে নানা চড়াইউতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে হাঁটতে থাকে। পাকিস্তানিরা তখন থেকে এই যুদ্ধের নেতাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। তিনি শেখ মুজিব। এরজন্যে বারবার তাকে জেলখানায় যেতে হয়েছে। এসবের গণবিস্ফোরন ঘটে উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানে। সত্তুরের নির্বাচনে। পাকিস্তানিরা-আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বাঙালি জাতির নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতো। জিয়াপিয়াদের সঙ্গে নয়। বাঙালির মুক্তি আন্দোলন ঠেকাতে পাকিস্তানিরা পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেছে। জিয়াপিয়াদের নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনার খবর আন্তর্জতিক গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর নামে ছেপেছে। জিয়াপিয়াদের নামে নয়। মুক্তিযুদ্ধের গান লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে। ‘শোন একটি মজিবরের থেকে লক্ষ মজিবরের কন্ঠ থেকে ধবনি, প্রতিধবনি আকাশে বাতাসে ওঠে রনি’, বা ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাতে যুদ্ধ করি।‘ জিয়াপিয়াদের নামে কোন গান লেখা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে যাবার আগে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে শপথ নিতো’। অপারেশনে বিজয় শেষে আনন্দধবনি করতো জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে। কেউ কোনদিন জয় বাংলা, জয় জিয়া বলেনি। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছেন! কিন্তু তার স্ত্রী খালেদা জিয়া বহাল তবিয়তে সেনানিবাসে বসবাস করেছেন! কর্নেল তাহের যুদ্ধে যাওয়ায় পাকিস্তানিরা তার নেত্রকোনার পূর্বধলার কাজলার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে আর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষনা দেয়া স্বত্ত্বেও তার বগুড়ার গাবতলীর বাড়িতে ফুলের আঁচড়ও দেয়নি! বোঝা যায়?

বঙ্গবন্ধুর হত্যা ষড়যন্ত্রে সাংবাদিকরাও জড়িত ছিলেন। বিচিত্রার শাহাদাত চৌধুরী সাংবাদিক আবেদ খানকে খুনিদের ইন্টারভ্যু করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবেদ খান সেই ইন্টারভ্যুর ভিত্তিতে একটি রিপোর্টও করেছিলেন। সেই রিপোর্ট ইত্তেফাকে ছাপাও হচ্ছিল। কিন্তু রাতের বেলা খবর পেয়ে প্রেসে ছুটে গিয়ে ছাপা বন্ধ করে সে রিপোর্ট তুলে ফেলে দেন ইত্তেফাকের সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। আবেদ খান ‘কালের কন্ঠে’, ‘ইতিহাসের কাছে আমার দায়’ শিরোনামে লিখেছিলেন পুরো ঘটনা। সেখানে লিখেছিলেন রিপোর্টটি প্রকাশ হলে অন্তত বঙ্গবন্ধু এবং দেশবাসী ঘটনাটি জেনে সতর্ক হতে পারতেন। সেই রিপোর্ট হত্যা করার কোন দায় নেই আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর? সেই ষড়যন্ত্রে শরীক হবার কোন দায় নেই শাহাদাত চৌধুরীর? খুনিরা যতোদিন দেশে ছিল তাদের মিটিং পয়েন্ট ছিল দৈনিক বাংলা ভবনের বিচিত্রা অফিস। এখানে তারা আড্ডা দিতো ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক বড়মাপের সাংবাদিক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক শাহাদাত চৌধুরী। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সহায়তার তার দায় মরনোত্তর হলেও থাকবেই।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড নিয়ে খুনির দল এখনও নানান গৌরব আলোচনা করে! ‘ভালো একটি কাফনের কাপড়ও জোটেনি শেখ মুজিবের’! রেশনের মার্কিন কাপড়ে তার দাফন হয়েছে!’ মুর্দার গোসল হয়েছে ৫৭০ কাপড় কাচা সাবানে! এগুলো কি গৌরবের? না জাতীয় লজ্জার? আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ সহ  অঙ্গসংগঠনগুলোয় তখনও অনেক বদমাশ লোকজন ছিল। এখনও আছে। নতুবা এই ভয়াল হত্যাকান্ডের তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ কেনো হবেনা? সব নেতাকর্মীকে কি তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল? বাকিরা কি কাপুরুষের মতো পালিয়ে যায়নি? এখন আওয়ামী লীগের ঘর জায়গা হচ্ছেনা নেতাকর্মীদের ভিড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ লক্ষ আইডিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি! সারাক্ষন লিখে ‘সহমত ভাই’! এদের বেশিরভাগের তৎপরতায় আমি পচাত্তরের সেই বদমাশদের ছায়া দেখি।

পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় আমি প্রথম টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধির পাশে যাই। গোপালগঞ্জ শহর থেকে হেঁটে যেতে যেতে ভাঙ্গাচোরা পথের অবস্থা দেখে একটা কথা কান্না হয়ে মনে বেজেছে। তাহলো,  যার জন্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, বাংলাদেশের নানান জনের জীবনের একটা রাস্তা হলো, তার বাড়িতে সমাধিতে যাবার একটি ভালো রাস্তা নেই! একা সেই বাড়িতে কেয়ারটেকার বৈকুন্ঠ দাস ছাড়া আর কেউ সেখানে ছিলেননা। অন্ধকার রাতে ডিমভাজি করে বৈকুন্ঠ দা আমাকে ভাত খেতে দেন। এখন সবকিছুতে উপচেপড়া ভিড় দেখে ভাবি সময়মতো এগুলোও পালাবে। কারন বেশিরভাগ নানান ধান্ধায় আছে, থাকে। কেউ ফ্রি খাটেনা।

আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় খুনিদের দোসররা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা লিখতে দেখলে এসে কমেন্টসে লিখে ‘মুসলমানদের জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম, ইত্যাদি। এদের আব্বুরা কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে জাতির পিতা বলতো-লিখতো। বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারেই এরা সূচিবায়ুগ্রস্ত! কারন দালাল-রাজাকারের বীর্যেতো দালালই জন্মায়। বাংলাদেশের মোল্লা-মৌলভীদের বেশিরভাগ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে জাতির পিতা জেনেমেনে তার জন্মদিন-মৃত্যুর দিনে নানা কর্মসূচি পালন করতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন-হত্যার দিনে তারা নীরব কবি! আমার কাছে এরা আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বংশধর। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত থাকলে এরা কবে চলে যেতো। এখানে তাদের দমবন্ধ হয়। কারন একজন হিন্দু কবি এখানে জাতীয় সঙ্গীত লিখেছেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।‘ তাই তারা এই জাতীয় সঙ্গীত গান না। পাকিস্তানিদেরটা ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ দরদ দিয়ে গাইতেন। বাংলাদেশে এমন প্রচুর বাংলাদেশের উৎস-অস্তিত্ব বিরোধী লোকজন বাস করে।

সিডনির লাকেম্বার রেলওয়ে প্যারেড সড়কের নাম ‘বঙ্গবন্ধু প্যারেড’ নামকরনে স্থানীয় কাউন্সিল রাজি হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের লোকজন তাতে আপত্তি জানিয়ে আটকে দেয়। এটা তারা গৌরবের সঙ্গে বলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের কাছে দলীয় নেতা-আওয়ামী লীগের নেতা! বঙ্গবন্ধুতো আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন। মুসলিম লীগ বা জামায়াতের নেতা নন। কিন্তু তিনি পরবর্তিতে বাংলাদেশের নেতায় রূপান্তরিত হন। তার নামে-নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কারনেইতো আমরা আজ বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে এসেছি অস্ট্রেলিয়ায়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আমরা পাসপোর্টের জন্যে করাচিও যেতে পারতামনা। আমাদের অস্ট্রেলিয়া আসাও হতো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিডনিতে মাত্র পাঁচজন বাঙালি ছিলেন যারা করাচি পর্যন্ত যেতে পারায় পাসপোর্টের মালিক হতে পেরেছিলেন। ইতিহাস না জানা লোকজনই এমন দেশেবিদেশে বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে যারা মানেনা আবার কাছে তারা হতভাগ্য, বাংলাদেশ পন্থী-মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ না। কারন মুক্তিযুদ্ধের নেতাকে বাদ দিয়ে এ দুটির একটাও হওয়া সম্ভব না।

ভালো থেকো পিতা। তোমার ছেলেরামেয়েরা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। বাংলাদেশ আর কোথাও মাথা নোয়াবার নয়। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

ফজলুল বারী