লিখছি, অনেক বছর। এই কলামের লেখাগুলোও লিখতে শুরু করেছি প্রায় তিন বছর আগে। নূতন করে তুলে নিয়ে আসছি সিডনী বাঙালী পাঠকদের জন্যে। আজকের বিষয়টি নিয়ে লিখবার আগে, যারা প্রথমবারের মত পড়ছেন মুলতঃ তাঁদের জন্যেই ছোট্ট একটু ভূমিকা দিয়ে নিতে চাই।
লেখালেখির বয়েস কম না হলেও, নানান কারণে আমার একক কোন প্রকাশনা হয়ে উঠেনি। দেশে প্রবাসে অনেকগুলো পোর্টাল সম্পাদকগণ আমাকে অসাধারণ সুযোগ করে দিয়েছেন, নিয়মিত কিছু কলাম এগিয়ে নিয়ে যাবার। প্রিয় লেখালিখিকে ভালোবেসে প্রতিদিন কম বেশী লিখে যাচ্ছি, লিখছি ‘’পরবাসী মন’’। এলোমেলো অনেক অনেক ছেঁড়াছেঁড়া অনুভূতি নানানভাবে প্রকাশ করে যাচ্ছি, কিছু অনুভূতিই বিশ্বের অন্য কোন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোন না কোন প্রবাসী বাংলাদেশীকে গেঁথে দিচ্ছে এক বিনা সুতার বন্ধনে যেন। অনেকেই বলছেন, এ যেন তাঁদের কথাই। এই পাওয়াটুকু সম্বল করেই খুব চাইছি যতদিন বেঁচে আছি লেখালেখি চালিয়ে যেতে , না-বলা নিজের কথা অন্য অনেকের কথাই তুলে ধরতে আমার মত করেই।
লিখছিলাম পরবাসী জীবন বেছে নেয়ার প্রেক্ষিত বা প্রেক্ষাপট এবং পরিবর্তী জীবন প্রবাহ। লিখছি আমার ৯/১০ বছরের অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই। এর মাঝেই বলেছি দেশ ছেড়ে উড়বার আগের মানসিক অবস্থা বা প্রস্ততি এবং সেই যাত্রা অভিজ্ঞতা নিয়ে। আজকে শুধুই বলতে চাই বিভূঁই কোন এয়ারপোর্ট থাকা সময়, হতে পারে তা ক্ষণিক যাত্রা বিরতি বা গন্তব্যের এয়ারপোর্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে!
বাংলাদেশ থেকে লন্ডন আমেরিকা ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়া যেখানেই যাই আমাদেরকে মাঝখানে নিতে হয় একটা বা দুইটা ট্রানজিট বিরতি। কানেক্টিং ফ্লাইট ২/৩ ঘন্টার মাঝে হলে সেটা এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যাওয়া এবং রেস্টরুমে একটু ফ্রেশ হতে হতেই কেটে যায় সময়। বরংচ অনেক সময় থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার এয়ারপোর্টে দেখা যায় একটা টার্মিনাল থেকে অন্য একটা টার্মিনাল রীতিমত দূরের। বেশ তাড়া নিয়েই পৌঁছে যেতে হয় নিদৃষ্ট টার্মিনালে।
জীবনের প্রথম ট্রিপ হলে এমনিতেই একটা বাড়তি টেনশন কাজ করে। স্বল্প বিরতির ট্রানজিট হলে আমার মনে হয় ফ্লাইট থেকে নেমেই দেখে নেয়া কত নাম্বার টার্মিনালে ফ্লাইট অবতরণ করেছে এর পরের ফ্লাইট টার্মিনাল নাম্বারটা কত। ইন্টারন্যাশনাল যেকোন এয়ারপোর্ট জুড়েই থাকে ইলেক্ট্রনিকস ডিসপ্লে বোর্ড, নিদৃষ্ট দূরত্বের মাঝেই। বিমান থেকে নেমে সামনে এগিয়ে গেলেই তা চোখে পড়বে। তবে পরবর্তি ফ্লাইট যদি ২/৪ ঘন্টার মাঝে না হয় তবে অনেক সময় সেটা বোর্ডে থাকেনা। কারণ বোর্ডে মুলতঃ মোস্ট রিসেন্ট ফ্লাইট ডিটেইলসই থাকে। সেক্ষেত্রে একটাই উপায় এগিয়ে গিয়ে যেকোন ইনফরমেশন সেন্টারে জিজ্ঞেস করে নেয়া, নেক্সট ডেস্টিনেশন কোথায়, কোন এয়ারলাইন্স, অবশ্যই পেয়ে যাবেন তথ্য।
এই প্রসঙ্গে আরো একটা বিষয় শেয়ার করি। অনেক সময় আমরা যারা বাইরে আছি তাঁদের মা-বাবা ভাই-বোন বা আত্নীয় পরিজন আসেন ভিজিট ভিসায়। বিশেষ করে অনেক মা-বাবার জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণটাই দেখা যায় এমন লম্বা কোন ট্রিপ হয়ে যায়। মা-বাবা একসাথে হলে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তবে কেউ একা বাংলাদেশ থেকে উড়ে আসছেন এবং প্রথম বারের মত এটা অনেককেই বেশ উদ্বিগ্ন করে ফেলে।
যেটা করতে পারেন, বয়োজৈশষ্ঠ মা বাবার জন্যে টিকেট কাটার সময় এয়ারলাইন্স থেকে বা ট্র্যাভেল এজেন্টকে অবশ্যই বলবেন সার্ভিস এসিস্টেন্স’ দিতে । সেক্ষেত্রে ট্রানজিট সময়ে এয়ারলাইন্স ক্রু মা/বাকে হুইল চেয়ারে করে পৌঁছে দেবেন নিদৃষ্ট টার্মিনালে। কোন কারণে সেটি না হলে, মা-বাবা র হাতে যেন থাকে পরবর্তী ফ্লাইট ডিটেইলস সেটি বলে দেবেন। অনেক সময় কোন না কোন সহযাত্রী পাওয়াই যায়। তবে সবচেয়ে বড় কথা কেউ খুব দুশ্চিন্তা করলে তাঁকে অবশ্যই বলে দেবেন, পরের যে ফ্লাইটে উনি যাবেন তারা সময় মতো তাঁকে না পেলে তাঁর নাম ধরে এনাউন্স করবে এবং তাঁকে খুঁজে বের করবে। (যদিও বিদেশ বিভূঁইয়ে বিদখুটে উচ্চারণে নিজের নামই হয়ে যেতে পারে অন্য কেউ, সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না)!!
অন্য যেকোন অচেনা এয়ারপোর্ট এ হুট করে কোন কিছু খুঁজে পাওয়া একটু ঝামেলার বৈকি। তবে মাথা ঠান্ডা রেখে একটু কমন সেন্স এপ্লাই করলে এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনাল খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু না বোধ হয়। বিমান থেকে নেমে সামনেই যে নাম্বারটা চোখে পড়বে সেই নাম্বার ধরে আগাতে থাকলেই পেয়ে যাবেন কাংখিত নাম্বার।
কিন্তু যদি ট্রানজিট লম্বা সময় যেমন ৮ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টার বেশী হয়, তাহলে কিন্তু বাড়তি কিছু প্রস্ততি থাকতেই হবে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে টিকেটেই ট্রানজিট হোটেল ইনক্লোড করা থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নাও থাকতে পারে, বিশেষ করে ৫/৭ ঘণ্টার যাত্রা বিরতি হলে। তাই অনেকেই সামর্থের মাঝে নিজের মত করে এয়ারপোর্ট হোটেলের ব্যাবস্থা করে নেয়। ইনফ্যাক্ট এয়ারপোর্টে নেমেও অনেক সময় করা যায়, তবে এটা মোটের উপর একটু ব্যায়সাপেক্ষ।
পারিবারিক ট্যুর হলে, বা একা হলেও একটা নূতন এয়ার পোর্ট ঘুরে ঘুরে সময় কাটানো মন্দ না। খাবারের আয়োজন খুঁজে নেয়া থেকে অন্য সব কিছুই এক্সপ্লোর করে কাটানো যায় অনায়াসেই ৫/৭ ঘণ্টা। খুব ক্লান্ত বোধ করলে বসা বা লম্বা হয়ে শুয়ে পাওয়ার ন্যাপ নেয়ার ব্যাবস্থাও থাকে এয়ারপোর্টেই। থাকে ফ্রী ইন্টারনেট এক্সেস খুব প্রয়োজনীয় কাজ থাকলে সেটা সেরেই ফেলা যায়।
হোটেলে সময়টুকু কাটালে সুবিধা হট শাওয়ার নিয়ে, ২/৪ ঘন্টা গড়িয়ে নেয়া যায়, জামা কাপড় বদলে, ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে শুরু করা যায় পরের যাত্রা। আর ঘুমিয়ে নিতে চাইলে রিসেপশনে বলে রাখলে তাঁরা আপনাকে ডেকেও দেবে ঠিক সময় মত।
লম্বা জার্নিতে শরীর ফিট থাকাটা খুব জরুরী। তাই এটা মাথায় রেখেই পুরো জার্নি প্ল্যান করা উচিত। কেউ কেউ অনেক বেশী এনার্জিটিক তাদের কাছে সব কিছুই রোমাঞ্চকর!!
এরপর কাংখিত সেই লম্বা একটা জার্নি, হতে পারে ৮/১০ ঘণ্টা থেকে ১৬/১৭ ঘন্টা। সেটি অনেকের কাছেই খুব বোরিং আবার অনেকেই জার্নিটা রীতিমত উপভোগ করেন। বিমান যাত্রা নিয়ে আগের লেখায় বলেছি অল্প বিস্তর।
আজ শেষ করি, গন্তব্যের যে এয়ারপোর্টে নামবেন তা যেন হয় সুখকর তার কিছু টিপস দিয়ে। বিশেষ করে আমরা যখন প্রথম বাংলাদেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোন দেশে পাড়ি দেই। সাথে করে ঠিক কি কি আনা যাবে বা যাবেনা বা আনা উচিত অনেকেরই সেটা জানা থাকেনা পরিষ্কার ভাবে।
আমরা হাঁড়িকুঁড়ি, মশলা পাতি এমনকি রান্নাকরা খাবার সহ আচার এবং অন্য অনেক কিছু ঢুকাই। অস্ট্রেলিয়ার এয়ারপোর্ট অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি, এখানে প্রতিটা স্টেট এয়ারপোর্টের আলাদা কিছু নিয়ম কানুন আছে।
আমি আমার পরিবার নিয়ে প্রথম বাংলাদেশ থেকে আসি সিডনী। তেমন ঝামেলা ছাড়াই কাস্টমস পার হয়ে যাই। সেই একই লাগেজ নিয়ে যখন সিডনী থেকে আমাদের মুল গন্তব্য এডেলেড, সাউথ অস্ট্রেলিয়া আসি, কাস্টমসে লম্বা সময় কাটাতে হয়। ওরা বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে তোমার সুটকেসে একটা কোন প্রহেবিটেট আইটেম আছে। আমার তো ভেতর থেকে ভয় লাগা শুরু করে, সিনেমার মত কোন না শত্রু পক্ষে (হতে পারে ভুল করে) আমার লাগেজে কি কিছু ঢুকিয়ে দিয়েছে। হায় আল্লাহ জীবনের প্রথম বিদেশে এসেই জেলে যাবো নাকি।
আমি বিনয়ের সাথে কাস্টম অফিসার’কে বলছি আমার জানা মতে তেমন কিছু নেই। তুমি চাইলে খুলে দেখতে পারো। সুটকেসের চাবি খুঁজতে যেয়ে দেখি অন্য সবগুলো ইজিলি খুললেও যে সুটকেস সাস্পেক্টেট সেটাই খুলেনা… সবই উত্তেজনার ফলাফল। সে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছে তুমি কি এমন কারো জিনিস এনেছ যা তোমার জানা নেই? এর উত্তর হাতড়াতে হাতড়াতেই সুটকেস খোলা গেলো। বিষয়টা তাই হলো, এখানে থাকা এক আত্নীয়ের জন্য তাঁর মা সোফার কভার পাঠিয়েছেন। সেই কভারে ছোট ছোট কাঠের/বাঁশের গোল গোল ঘুণ্টি বাধা। এখানে ওডেন বা ব্যাম্বো জাতীয় কিছু মানেই ডিক্লেয়ার করার কথা ছিলো, আমি তো ইনফরমেশন ফর্মে সেটা করিনি, যন্ত্রণা কাকে বলে!! প্রথমবার, অফিসার সবক দিয়ে বেস্ট উইশেস এবং ওয়েলকাম জানিয়ে ছেড়ে দিলো সেটা, তবে এই অভিজ্ঞতা গোটা জার্নিতে যা না হলো অল্প সময়েই চুপসে গেলাম।
সিডনি বা মেলবোর্নে অনেকেই বাংলাদেশ থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে আসেন, এডেলেড এ যা নেয়া যায়না। একজন পরিচিত গলদা চিংড়ী রান্না করে নিয়ে এসেছিলেন, এডেলেড এয়ারপোর্টে সেটা ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।
এক স্টুডেন্ট বাংলাদেশ থেকে বালিশ নিয়ে এসেছিলেন, শিমুল তুলার বালিশ, কিন্তু সেই বালিশে শিমুলের সিড ছিলো তাই সেটি আর পার পেলোনা। সিড এলাউড ছিলোনা। এমন আছে অনেক অনেক উদাহরণ।
কোন কিছু আনার আগে তা অবশ্যই কমার্শিয়াল প্যাক করে আনতে হবে। খাবার না আনাই ভালো। আর মা – বাবা এলে তাঁদের সাথে যেন এমন কিছু অবশ্যই না নিয়ে আসে যা তাঁদের প্রথম ট্রিপকেই করে তুলতে পারে আতঙ্কের সেটি সবার খেয়াল করা উচিত।
সুস্থ দেহ মন নিয়ে যাত্রা শুরু হোক প্রবাস জীবনের, নির্বিঘ্ন হোক সবার প্রথম বিদেশ অবতরণ!