ভিসা, হাই কমিশন এই শব্দগুলোর সাথে অনেক কিছু জড়ানো, আশা, প্রত্যাশা, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, অনুভূতির অনেক রঙ। একটা মানুষ যখন সিদ্ধান্ত নেয়, এই আয়োজন ঘিরে যখন সিদ্ধান্ত হয় ‘দেশ ছেড়ে যাওয়ার’ সাথে সাথেই শুরু হয় নানান গল্পের, টুকরো, টুকরো!!
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলি, স্টুডেন্ট, ওয়ার্ক, ইমিগ্রেশন বা ভিজিট যে ভিসাই হোক প্রতিটা দেশের জন্যে আলাদা করে ভিসা রিকোয়ারমেন্টস ফুলফিল করতে হয়। বাংলাদেশ এ থাকা হাই কমিশন অফিস মেনে চলে সেগুলো এবং যাচাই বাছাই করে কিছুটা স্থানীয় নিয়ম বা প্রেক্ষাপটে । এসব অফিসে প্রতিটা দেশের নাগরিক ছাড়াও অল্প কিছু পোস্টে কাজ করে বাংলাদেশীরাও।
বাংলাদেশে ৭ বছরেরও বেশি সময় আমার কাজের সুবাদে অভিজ্ঞতা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান হাই-কমিশনের বাংলাদেশ অফিসের সাথে কাজের। স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে কাজ, অফিসিয়াল চেক লিস্ট যা ছিল সেটাকে ধরেই স্টেপ বাই স্টেপ প্রসেজ নিয়ে আগানো। তারপরও প্রায় তিন মাস পরপর হাইকমিশনের মিটিং এ অফিসের পক্ষ থেকে যাওয়া হতো। নিয়মগুলো নিয়ে আলোচনা, মতামত নেয়াও হতো কিন্তু শেষমেশ বিবেচনা যে সব হতোনা সেটা বুঝতে পারতাম বেশ।
স্টুডেন্ট ভিসায়, মূলতঃ পরিষ্কার করেই দুইটা বিষয় দেখতে হতো, একাডেমিক এবং স্পন্সরশীপ মানে ফাইনানশিয়াল কাগজ পত্র। এই দুটোই হাই কমিশনের চেকলিস্ট অনুযায়ী মিলে যাওয়া এপ্লিকেশন খুব কমই পাওয়া যেতো। আমাদের কাজ ছিলো দুইয়ের সমন্বয় করে এপ্লিকেশন যতো বেশি সহজ করা যায়। ভিসা পাওয়ার জন্যে কমপ্লিকেশনগুলো এড়ানো যায়।
আমি কাজ শুরু করি ২০০১ এর ফেব্রুয়ারি, তখন নিয়ম ছিল, পেপার গুছিয়ে হাইকমিশনে স্টুডেন্টকে নিজে যেয়ে সাবমিট করে ইন্টারভিউ ফেস করা। এর অল্প কিছু সময় পর আমি যে অফিসে কাজ করতাম সেটাসহ আরও ৬ টা মোট ৭ টা অফিসকে হাইকমিশন স্পেশালি এলাউ করতো, অফিস থেকে একসাথে করে সব এপ্লিকেশন জমা দিয়ে অরিজিনাল পেপারস শো করে ইন্টারভিউ ফেস করে আসা। আমাদের মনে হত, বা ভাবতাম ‘উই আর জী-৭’!!
অফিস থেকে শুরুতেই সিনিয়র হিসেবে এই কাজটা করার সুযোগ আমার ছিল। তখন হাইকমিশনে বাংলাদেশী দুইজন তরুণ-তরুণী কাজ করতো। তরুণীটি, বলাই বাহুল্য উনার সাক্ষাতপ্রার্থীদের সাথে আচরণ ছিলো মনে রাখার মতোন। তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়া কারো সাক্ষাত শেষ হয়েছে সেটা শোনা যায়নি। তরুণটি ছিলো অনেকটাই রবোটিক, অভিজ্ঞতাও হতো সবার এইরকমই, তবে প্রফেশনাল বলতে যা বুঝায় সে বোধ হয় তারা ছিল।
আমার একদম শুরুটা ছিল খারাপই। কাগজপত্র চেক লিস্ট অনুযায়ী গুছিয়ে নিয়ে গেলেও, ভদ্রমহিলা কোন না কোন একটা ত্রুটি বের করতেনই এবং চেহারায় যতোটা বিরক্তি আনা যায় তাই নিয়ে আবার, আবার এবং আবার ঠিক করতে বলতেন। মানে কোন কোন ফাইল হাই-কমিশনে যাওয়ার পরও ৩/৪ বার গুছাতে হতো অতীব মন খারাপ নিয়ে।
অস্ট্রেলিয়ান একজন ভিসা অফিসার ছিলেন তাঁর সাথে দেখা হলে দিনই ভালো হয়ে যেতো। নাম মনে পড়ছেনা এখন। আমি প্রায়ই শাড়ী পড়ে যেতাম সেই সাত সকালেই, ভোর ৭টায় উনি এমন ভাবে হাসি দিয়ে, ইউ লুক বিউটিফুল এবং ‘গুড মর্নিং’ বলতেন, দিনটা ভালো না হয়ে যেতোই না, সে আবার কাজ করতে করতে গুনগুন করে গানও গাইতো।
বাংলাদেশী তরুণী কেন এমন করতো এবং সেই তরুণকে টানা বছর দুই কাজ করার পর সুযোগ এসেছে সেটা জানারও, কারণ দুইজনই আলাদা করে আমার সেই অফিসে এসেছেন এবং তরুণটিও একসময় অস্ট্রেলিয়া চলে আসে উচ্চ শিক্ষার্থে। আমাদের কাছে অফার লেটার সংক্রান্ত ছোট একটা সাহায্য নিতে হয়, তাই উনার আসা, আমরা ধন্য হই তাঁর জন্যেও একটা কাজ করতে পেরে!!
তরুণীর সাথেও একসময় সম্পর্কটা সহজ হয় আমার, জানা হয় উনার কাছের নেপথ্যের অনেক কথা। কেন বাংলাদেশিদের সাথে ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও হার্ড লাইনে যেতে হয় সেই বাস্তবতা উনি তুলে ধরেন যা দুঃখজনক লাগলেও সব ফেলে দেয়ার মতো না।
নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি, আমাদের পুরো এডুকেশন সিস্টেমের জন্যেই বাইরে পড়তে আসার সময় একটা স্টুডেন্টের ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে মিলিয়ে সাবজেক্ট পছন্দ করার বিষয়টিতেই একটা হিমসিম খেতে হয়। যে বিষয়টি নিয়ে পড়তে আসছে, সেটি কেন এটা লিখতে হতো, যেটাকে বলা হতো, ‘স্টেটমেন্ট অব পারপাস’। হাই কমিশনের কাছে স্টুডেন্টের ‘ইনটেনশন’ চেক… ওটা নিয়ে কাউন্সেলিং করতাম, বুঝিয়ে বলে দেয়া হতো, কি লিখতে হবে, কেন লিখতে হবে। আগে লেখা হয়েছে সেখান থেকে একটা ভালো স্যাম্পলও দেয়া হতো। কিন্তু বেশির ভাগ ছাত্রই সেটা সুন্দর করে লিখতে পারতোনা। এমন অনেক বেশিই হয়েছে, আমরা যা দেখার জন্যে দিয়েছি, সেটাই কপি করে নিয়ে এসেছে। একবার এমন হয়েছে, শুধু এই স্টেটমেন্ট অব পারপাস, এসওপি বলতাম যেটাকে এটার জন্যেই রিজেক্ট হয়েছে। অনেক ফাইলের মাঝে কোন কারণে হয়তো এমডি স্যার বা আমি সেটি চেক করিনি, স্টুডেন্ট এমন কপি জমা দিয়েছে হাই কমিশন যেটি পড়তে যেয়ে বুঝে নেয় এটা এর আগে অনেকবার পড়া হয়ে গেছে!!
স্পন্সরশীপের কাগজ খুব চেষ্টা থাকতো হাইকমিশন যেমন করে এক্সপেক্ট করে সেটা যতোটা ফুলফিল করা যায়। হাই-কমিশন প্রেফারেন্স ছিলো কেস টু কেস, ফার্স্ট ফ্যামিলি স্পন্সরশিপ, ভালো ব্যাংক স্টেটমেন্ট, স্যালারিড পারসন হলে একরকম, বিজনেজ হলে অন্যরকম। বিজনেস হলেই তারা দেখতে চাইতো বিজনেস একাউন্ট একটা, সেইভিংস বা অন্য একাউন্ট আলাদা।
এইসব একদম হাইকমিশনের মতো করে পাওয়া কঠিনই হতো। যা সবচেয়ে বেশি ভোগাত বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকই তখন পর্যন্ত ডিজিটাল হয়ে উঠেনি। ব্যাংক স্টেটমেন্ট আসতো হাতে লেখা, যা হাইকমিশন ভেরিফাই করতে যেয়ে অদ্ভুত সব ইনফরমেশন নিয়ে আসতো।
আমাদের পক্ষে বেশির ভাগ সময় স্টুডেন্ট এবং তার অভিবাবককে বিশ্বাস না করে উপায় থাকতো না, কথা বলে কনভিন্স হয়েই পেপার জমা দিতাম। টানা ৫/৬ মাস কাজ করলে অনেক কিছুই ঠিকঠাক করা যেতো, কিন্তু সেই ধৈর্য পাওয়া বিরল।
হাইকমিশন ল্যান্ড প্রোপার্টি পেপারস দেখালে অরিজিনাল দেখাতে বলতো, রেন্ট ইনকাম হলে রেন্টাল ডিড। এগুলো নিয়ে কাজ করতে যেয়ে উঠে আসতো ভয়াবহ সব তথ্য। কেউ হয়তো বাসা ভাড়া পাচ্ছে ১/২ লাখ টাকা তার ডিড বলছে ৫০/৬০ হাজার টাকা।
কেউ বছরে ইনকাম করছে ১২/১৪ লাখ, ট্যাক্স দিচ্ছে অনলি ফর ৬/৭ লাখ। জমি থেকে ইনকাম, কিন্তু জমি আছে অন্যকারো নামে। ট্যাক্স পেপার তো ৯৯% ই ঠিক পাওয়া যেতোনা।
কারো কারো মা-বাবার নাম ছেলে-মেয়ের পাসপোর্টে একরকম, তাঁদের ম্যারেজ সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য ডকুমেন্ট এ অন্যরকম। সব নামই যে এক ব্যাক্তির সেটা প্রায় বেশির ভাগ এপ্লিকেশনেই আলাদা করে ডিক্লারেশন দিতে হতো।
অফিসের এমডি স্যার খুব বেশি স্ট্রিক্ট ছিলেন, কোন পেপার মনমতো না হলে এপ্লিকেশন কিছুতেই জমা দিতে চাইতেন না। খুব চাইতেন উনার অফিসের সাকসেস যেন ১০০% থাকে।
আমার প্রতিটা পড়তে যাওয়া ছেলেমেয়ের চোখ মনের মাঝে গেঁথে যেতো, খুব চাইছে কিন্তু পেপার ঠিক করা যাচ্ছেনা এটা খুব ভোগাত আমায়। কিন্তু সবটুকু এফোরর্ট দেয়ার পরও কোন এপ্লিকেশন যখন রিফিউজড হতো এবং জানতে পারতাম কোন না কোন ফলস পেপার ছিলো, সেটা যে কি বেদনার, বলে বুঝাতে পারবোনা। খুব অল্প হলেও সে অভিজ্ঞতা হয়েছে।
এটা ঠিক হাই কমিশনগুলো আলাদা করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু আলাদা নিয়ম এপ্লাই করে। এই জায়গাগুলোতে বাংলাদেশীদের ভয়েস স্ট্রং না, কিছু নিয়ম যে আমাদের জন্যে ভীষণই কঠিন বা আমাদের পুরো সিস্টেম সাপোর্ট করেনা এটা বুঝানো যেতোনা, তখন পর্যন্ত।
স্পাউস ভিসায়, তারা দেখতে চাইতো হলুদ, বিয়ে, রিসেপশন এবং এক সাথে বাইরে গেলে তারও ডকুমেন্টস, এগুলো তো একটু অবাক করা বিষয়ই, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার প্রেক্ষাপটে (কিন্তু এই সত্য যদি তারা জানতো এইগুলোও নাকি এরেঞ্জ করে ফেলতো কেউ কেউ)!!
স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে বিষয়গুলো বললাম, কারণ একটাই যেনতেন ভাবে বাইরে আসতেই হবে এটা যতোনা কোন স্টুডেন্ট চাইতো, অভিভাবক ছিলো তার চেয়ে বেশি উৎসাহী। নানান রকম কাগজ বানিয়ে আনাকে অনেকেই কিছুই মনে করতোনা। যেন এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
কাজ করতে করতে বুঝে যেতাম কোনটা আসল কোনটা বানানো। কাউকে বলা ‘’এই পেপারটা ফলস’’ এর চেয়ে বিব্রতকর আর কি হতে পারে।
বাংলাদেশীদের এপ্লিকেশন পৃথিবীর সব হাইকমিশন যথাযথ সম্মান নিয়ে দেখুক, আমরা যেন সেটা ডিজারভ করি, এটা মন থেকে চাই। আমাদের অনেক কিছুই হচ্ছে কিন্তু অল্প কিছু বাংলাদেশীর অসততার দলিলগুলো থেকে যায়, সামনে এসে যায় কোন না কোন ভাবে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে!!
আমাদের আত্বসম্মানবোধ থাকুক, আমাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে পড়তে যেতে চাইলে, সেটা মাথা উঁচু করে সসম্মানে যাক। কোন হাই-কমিশন অভিজ্ঞতা যেন তাকে বাকিটা জীবন তাড়িয়ে না বেড়ায়!!
আমার জানা মতে কিছু ফলস ডকুমেন্ট এর রেকর্ড হাইকমিশনে থেকে যায়, এরপর যত ভালো ভাবেই আবার পেপার সাবমিট করা হউক, প্রথম এপ্লিকেশন কেন ফ্রড সেটা না বুঝাতে পারলে ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
সময়ের প্রয়োজনে ভিসা হয়তো কোন একটা সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ, এক জীবনের পুরোটা মনের মতন করে উপভোগ করতে পারার নাটাইটা হাতছাড়া না হয়ে যাওয়া!!
পূর্বের পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন