পরবাসী মন ধারাবাহিক লিখছিলাম সিডনী বাঙালী পাঠকদের জন্যে। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং একান্ত কিছু অনুভব লিখেছিলাম নিজের মত করেই। অল্প কিছু পাঠককে ছুঁয়েছিলাম অনেক বেশী ভালোবাসায়। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও লম্বা বিরতি নিতেই হচ্ছে কোরোনার এই অনিশ্চিত সময় মাথায় রেখে। আজ আবার এলাম এবং অবশ্যই আজ একটু বেশী বেশী ভালোবাসা নিয়ে কিছু লিখে ফেলবো আশা নিয়ে বসা।
মুল লেখার আগেই ছোট্ট করে দুইটা কথা না বললেই নয়। শুধু লেখালিখির জন্যেই আমি আমার ফেসবুক জগতে কজন গুরুজন পেয়েছি, প্রেমিক, বন্ধু পেয়েছি যারা আমাকে বা লেখার আমিটাকে খুব বেশী আপন করে নিয়েছেন। মাঝে মাঝেই আপন করে মেসেজ পাঠান কেন আবার ফিরছিনা। এ পাওয়াতে মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস এসে গেলেও, অন্যরকম একটা আনন্দেরও নাম এটিই। তাঁদের প্রতি খুব খুব কৃতজ্ঞতা এবং সিডনী বাঙ্গালীর কর্ণধার তারিক ভাই, যার জন্যেই এই পুরোনো লেখাগুলো নূতন করে নিয়ে আসতে পারছি। আজ আরো একবার ধন্যবাদ না দিলেই নয় তাঁকে।
যারা প্রথম বারের মতন পড়ছেন তাঁদের একটু বলে নেই। লিখছিলাম, একজন প্রবাসী হিসেবে দেশ ছাড়ার আগের পরের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা, একেবারেই নিজের মতন করেই।
যেখানে এসে থেমেছিলাম, সেখান থেকেই করি শুরু। প্রবাস জীবনের শুরুটা সবার একরকম হয়না। স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যে আসেন তার একরকম। পারমানেন্ট ভিসা নিয়ে সিঙ্গেল যে আসেন তাদের বা পরিবার নিয়ে যারা আসেন তাদের সবার কিছু আলাদা আলাদা বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়। সব নিয়ে আজ না বলি। অবশ্যই আমার জানাটুকুই শেয়ার করবো।
আমি এসেছি আমার পরিবার নিয়ে। একমাত্র ছেলে নভঃ আর ওর বাবাকে নিয়ে। নভঃ তখন ৪+। এসেই পুত্রকে নিয়ে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি আজ তাই নিয়েই কিছু বলি।
অস্ট্রেলিয়ার নিয়ম অনুযায়ী যে যে এলাকায় বসবাস করে বাচ্চাদের স্থানীয় স্কুলেই দিতে হয়। ইনফ্যাক্ট ঠিকানা অনুযায়ী স্কুল জোন ভাগ করে দেওয়া… আমাদেরকেও তাই করতে হলো। স্কুলে যোগাযোগ করে ঠিক করা হলো এডমিশন।
শুরুতে রিসিপশন ক্লাস। মানে মেইন স্ট্রিমে বাচ্চাকে নেয়ার আগে ঠিকঠাক করে নেওয়া বা তার প্রস্তুতি।
একমাত্র ছেলে এবং যৌথ পরিবার ছেড়ে আসার জন্যেই হোক বা অন্য কারনেই, যা নিয়ে শুরুতেই বিপত্তিতে পড়লাম। সুপার শপে কেনাকাটা করতে গেলেই সে ইচ্ছেমত জিনিস নিয়ে নিতো ট্রলিতে। অল্প করে করে ট্রলিতে রেখে দিত। না নিতে দিলে মোটামুটি একটা সিন ক্রিয়েট। এখানকার সুপার শপের বেশীর ভাগ চেক আউটগুলোতেও থাকে বাচ্চাদের নানান সামগ্রী এই যেমন কমিক বই বা সুপার হিরোদের নিয়ে কোন মলাটবাঁধা ম্যাগাজিন বা বইয়ের সাথে আরো কিছু না কিছু দিয়ে প্যাকেট করা। দামটা একটু বেশিই। শুরুতে সাথে নিয়ে আসা জমানো টাকা ভেঙ্গে কাজের জিনিস ছাড়া এমন কিছুতে টাকা ঢালতে বলাই বাহুল্য নিজের মনের অজান্তেই ডলার টাকার হিসেবটা মাথায় এসে একটা ভোঁতা যন্ত্রণা দিয়ে যেত। আহা কি যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে কতদিন।
এই সমস্যা থেকে মুক্ত হতে ছেলেকে নিয়ে শপিং যাওয়াই বাদ দেবো, নাকি অন্যকিছু কাছের দূরের সবার পরামর্শ নিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে লাগলাম এবং অনেকটা বাধ্য হয়েই সময়ের উপর ছেড়ে দিলাম। সময়ই দিলো পরিত্রাণ।
১৭ অগাস্ট ২০০৯ এ আমরা এডেলেড, সাউথ অস্ট্রেলিয়া পা রাখলাম। এরপর এক সপ্তাহের মাঝেই স্কুলে যোগাযোগ হল। অল্প কদিন পরই একটা টার্ম ব্রেক সেপ্টেম্বর এ এবং এর পর থেকে শুরুতেই স্কুল বাস এসে ওকে নিয়ে যাবে এমন সুবিধাই পেলাম আমরা শুরুতে।
আনন্দ চিত্তে ছেলেকে স্কুলে দিলাম। নিজে একটা কাজে ঢুকলাম। কিন্তু শুরু হলো আরেক অজানা সমস্যা। সত্যি কথা বলতে এই সমস্যাটা ফেস করতে যেয়ে মনে হয়েছিলো, নাহ প্রবাস জীবনে টিকতে পারবোনা বুঝি আর।
ছেলে যখন তখন খুব বেশী জেদ করে সব নিয়ে। কখনই যা করতোনা, মা বাবার গায়ে হাত তুলে। ঘুমাতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই প্রায় প্রতি রাতেই সিনক্রিয়েট। সকালে ওর স্কুল, নিজে কাজে যেতে হয়, একদম ঘড়ির সাথে পাল্লা দিতে না পারলে সকাল থেকেই নানান বিপত্তির মুখোমুখি। সব মিলে এমন হতাশা, লিখতে গিয়েও মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে আজ।
বাধ্য হয়ে ছেলের স্কুলের দাড়স্ত হলাম। স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্বে থাকা ‘জিনি’ নাম, তাঁর নামের পরের টাইটেলটা ভুলে গেছি, পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রমহিলা আমাদের অনেক লম্বা সময় দিলেন। শুনলেন এবং আমাদের অনেকগুলো জার্নাল, পেপার, ইনফরমেশন দেয়ার পাশাপাশি যে তথ্যটি দিলেন সেটি শেয়ার করতেই আজকের এই লেখা আসলে।
উনি লম্বা সময় ধরে যা যা বুঝালেন, তার মাঝে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো, উনি বলতে চেয়েছেন ছেলে একটা কমিউনিকেশন গ্যাপে পড়েছে। কালচারাল ডিভার্সিটি বলেও একটা টার্ম শুনেছিলাম আগেই, সেটা বা কিছুটা ভাষা সংক্রান্ত এবং অন্যান্য। সবমিলে একটু সময় আমাদের ধৈর্য ধরতেই হবে। হতাশার কিছু নেই। সময়ই ঠিক করে দেবে ওকে পুরোপুরি।
বেশ কিছু সিটিং এরপর একদিন আমার ছেলেকে নিয়েই জিনির কাছে বসা হলো। দুর্দান্ত কাউন্সিলর সেই ভদ্রমহিলা আসলে। মজা করে কথা বলতো খুব, ওর একটা কথা আমি সময় মাথায় রেখেছি এবং ভালো হয়েছে কি মন্দ হয়েছে জানিনা কিন্তু আমার মনের মত হয়েছে।
চার বছর বয়েসে নিয়ে আসা আমার ছেলেকে ও বলেছিলো বাসায় আমাদের সাথে যেন ওর মাদার ল্যাংগুয়েজ এ কথা বলে। নভঃকে বলেছিলো, ইংলিশ তুমি এমনিতেই শিখে যাবে, কিন্তু তুমি যদি তোমার মাদার ল্যাংগুয়েজটা ভুলে যাও, যখন বাংলাদেশে তুমি তোমার গ্র্যান্ড পেরেন্টেস এর কাছে বেড়াতে যাবে ওদের কথা বুঝতে পারবে, বলতে পারবে কত ভালো লাগবে তোমার। নভঃ এই টিপস মনে থাকার কথা না, কিন্তু কি এক অদ্ভুত কারণে ছেলে আমাদের সাথে মানে বাসায় ইংরেজীতে আর কথা বলেইনি। এখনও বলেনা। বন্ধুদের সাথে বললেও, আমাদের সাথে না (অবশ্য এর একটা কারন হতেই পারে আমাদের ইংলিশ বলাটা অন্যরকম)।
স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশ থেকে আসা বা এখানে জন্ম নেয়া বাচ্চারা কেউই বাংলায় কথা বলাটা এঞ্জয় করেনা এবং আমাদের অনেক মা বাবাও সেটা চাননা। এটা ভালো কি ভালো না আমি আসলে এটা নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। শুধু বলতে চাই, ইংলিশ আমাদের বাচ্চাদের শেখানোর কিচ্ছু নেই, নেই কিন্তু। খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্কুল থেকেই ওরা শিখে নিচ্ছে ওদের মত করে আর বাচ্চাদের শিখে নেয়ার ক্ষমতাটাও মা বাবার থেকে অনেক গুন বেশীই। ওদের সাথে আমাদের তাই ইংরেজীতে কথা না বললেও আমার মনে হয়না এটা কোন মারাত্নক ক্ষতি হয়ে যাবে।
বাচ্চাদের নিয়ে এসে শুরুতেই যে মা বাবা চিন্তায় থাকেন, তাঁদের জন্যেই আজকের চিঠি। ভালো থাকুক আমাদের সন্তানেরা, বেড়ে উঠুক দারুণ মানবিক সুস্থ মানুষ হয়ে…
নাদেরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
৫ জুন ২০২০