ফজলুল বারী:নিউইয়র্ক প্রবাসী চিকিৎসক ফেরদৌস খন্দকার দেশে আসছিলেন। তাঁকে নিয়ে একটি সেমসাইড ভুল ঝড় বয়ে গেলো সোশ্যাল মিডিয়ায়। ‘আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগ যুদ্ধ’! এবং এতে দূর্ভাগ্যজনক আক্রান্ত জড়িত হয়ে গেলো রাষ্ট্রও!
নিউইয়র্ক থেকে রবিবার বিশেষ ফ্লাইটটিতে ১২৯ জন যাত্রী এসেছেন ঢাকায়। এরমাঝে ওই চিকিৎসক ছাড়া বাকি সবাইকে হোম কোয়ারিন্টানে পাঠানো হয়েছে। আর ‘বিপদজ্জনক’ ওই চিকিৎসকে রাখা হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারিন্টানে।
সরকারি তরফে বলা হয়েছে ওই চিকিৎসকের শরীরে করোনার লক্ষন আছে। আর চিকিৎসক বলছেন তাঁর সঙ্গে আছে এন্টিবডি সনদপত্র। আমেরিকার এন্টিবডি সনদপত্রকে পাত্তা দেয়নি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু এর মাধ্যমে চিকিৎসা পেশার লোকজনের উদ্দেশে একটি ভুল বার্তা দেয়া হলো। বাংলাদেশের করোনা যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনার চিকিৎসকদের সহায়তার নিয়তে ইনি ঢাকা এসেছিলেন। দেশেও এমন নজির আছে।
মফঃস্বলের অখ্যাত হাসপাতালে থাকা এক চিকিৎসক একদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাজির হয়ে বললেন তাঁকে এমন হাসপাতালে নিয়োগ দেয়া হোক যেখানে করোনা রোগী বেশি। তাঁর এমন ভূমিকায় শুরুতে চমকে ওঠেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা।
কারন এই দূর্যোগের সময় এমন চিকিৎসকও আছেন যিনি গায়ে পড়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ন হাসপাতালে পোষ্টিং নিয়ে করোনা রোগীর সেবা করতে চাইছেন! তাঁকে তাঁর ইচ্ছামত পোষ্টিং দেয়া হয়েছে। তিনি নিরলস সেবাও দিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু নিউইয়র্কের চিকিৎসক যখন এই নিয়তে বাংলাদেশে যাচ্ছি ঘোষনা দিলেন তখনই বিশেষ একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দেশের একজন স্বনামখ্যাত সিনিয়র সাংবাদিকের এক ফেসবুক পোষ্ট থেকে সূত্রপাত ঘটে টাগ অব ওয়ারের।
কারন তাঁর পোষ্টকে তথ্য উপাত্তের কারনে সবাই বরাবর গুরুত্ব দেন। তিনি তাঁর পোষ্টে লিখেন, এই ডাক্তার খুনি খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে এবং বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি রশিদের খালাতো ভাই!
ব্যাস শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। টাগ অব ওয়ার। কারন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে থাকাকালীন ফেরদৌসের সহপাঠীরা তাঁর পক্ষ নেন। তিনি ছাত্রলীগ করতেন। এরমাঝে অবশ্য এটি প্রতিষ্ঠিতও হয়ে গেছে অভিযোগটি ভুল।
বেচারার বিপদের কারন তাঁর বাড়ি কুমিল্লায় আর নামের সঙ্গে ‘খন্দকার’ যুক্ত আছে। মোশতাক নামের তাঁর এক মামা আছেন যিনি থাকেন বোস্টনে। এখন এই ভুলটি কিভাবে হয়েছে সে সম্পর্কে আমি একটি ধারনা পেয়েছি।
আমার মতো যারা বিদেশে থাকেন তারা এমন পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত। বিদেশে আমরা যারা আছি তারা দেশের নীতি আদর্শ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে বিদেশে আসিনি। বিদেশে এসব বাস্তবায়নের কোন সুযোগ নেই।
দেশের রাজনীতি বিদেশে করার কোন সুযোগও নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন অস্ট্রেলিয়ায় যারা করেন তারা সামাজিক সংগঠন এগুলোকে নিবন্ধীভূক্ত করে নেন। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে কী আচরন!
আওয়ামী লীগ-বিএনপি বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন। অথচ এসবকে সামাজিক সংগঠন হিসাবে নিবন্ধীভূক্ত করা হচ্ছে! এর বাইরে কোন সুযোগও নেই। ভারতের বিজেপির বাংলাদেশ শাখা কী আপনি করতে দেবেন?
ভারতীয়রা বিদেশে গিয়ে কংগ্রেস-বিজেপি এসব করেনা। এরজন্যে নরেন্দ্রমোদী বিদেশ গেলে তার বিরুদ্ধে কোথাও ভারতীয়রা বিক্ষোভ দেখায়না। কিন্তু শেখ হাসিনা বিদেশে যেখানে যান সেখানে বিক্ষোভ দেখায় বিএনপি। লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়।
বুঝতে পারি ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যতকিছু ঘটেছে এর সূচনাভূমি নিউইয়র্ক। আমি সিডনিতে থাকি এখানকার কোন সভা সমিতিতেই যাইনা বলে নিরাপদে থাকি। এমন কি সাংবাদিকদের সভা সমিতিতেও না।
সাংবাদিকতা এখানে কারো পেশাও নয়। মনের টানে চুপচাপ নিজে নিজে লিখি। ১৯৮৭ সাল থেকে সাংবাদিকতা করি। আমার সহকর্মী বা জুনিয়ররা দেশের প্রায় সব মিডিয়ায় নেতৃত্বে অথবা মন্ত্রী অথবা সংসদ সদস্য অথবা বড় আমলা।
তাদের চেয়ে আমার যোগ্যতা কম বলেইতো আমি বিদেশে। কামলা দিয়ে খাই। দেশেও অনেকে আমার রোজগারের ওপর নির্ভরশীল। আমরা যখন শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সারাদেশে ঘুরে বেড়াতাম তখন দেশে অত সাংবাদিক বা মিডিয়া ছিলোনা।
জনকন্ঠে কাজ করতাম বলে খালেদা জিয়ার গাড়ির বহর ইচ্ছে করে প্রায় ঢাকায় ফেলে চলে যেতো! কিন্তু খালেদা জিয়ার সফর কভার করার অফিসের এসাইনমেন্ট। এরজন্যে বিএনপির মিডিয়া টিম ঢাকায় ফেলে গেলেও হয়তো নিজে নিজে বগুড়ায় চলে গিয়ে বহরের গাড়ির সঙ্গ নিতাম।
আর এখন মাঝে মাঝে অনেকে প্রশ্ন তোলেন আমার লেখা যে আওয়ামী লীগের পক্ষে লিখেছি বা পক্ষে গেলো এটা কার পারমিশনে লিখছি! এমন পারমিশন দেনেওয়ালাও অনেক হয়ে গেছেন!
আমার অভিজ্ঞতা বিদেশের সভা সমিতিতে যত কম যাওয়া যায় তত শান্তিতে থাকা যায়। কারন এগুলো সব ছোট ছোট গ্রুপ। এক সভায় গেলে আরেক পক্ষ মনে করে আপনি বুঝি ওই গ্রুপের সদস্য!
এসব সভা-সমিতিতেও যে একেবারেই যে ভালো কাজ হয়না তাও নয়। তবে এমন ঘটনা কম। ডাঃ ফেরদৌস সম্ভবত এমন কোন পরিস্থিতির শিকার। সিডনিতে যে সব বাংলাদেশি চিকিৎসক প্র্যাকটিস করেন তারা কোন সভা সমিতিতে সাধারনত যাননা।
এদেশে অবশ্য আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো অত লোকজনও নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় এমন একটা সমস্যা হয়ে যাচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন কর্তৃ্ত্বে।
প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সঙ্গে পরামর্শ করে হাইকমিশনার এরজন্যে প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি করেন। সেখানে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়েছিল তিনি আওয়ামী লীগ করেননা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই আপত্তি নাকচ করে দিয়ে বলেন সবার আওয়ামী লীগ করতে হবে নাকি। তিনি ভালো চিকিৎসক। আমি দেশেও তাঁর নাম শুনেছি। ব্যাস, বেঁচে যায় তাঁর মান ইজ্জত।
নিউইয়র্কের এই ডাক্তার সেখানে ঘরে ঘরে গিয়ে করোনা রোগী সেবা করেছেন এই প্রচারনাও হিতে বিপরীত হয়েছে। ছাত্রলীগ করা ডাক্তার। প্রচার পাবার অভ্যাস। বলা হয়েছে নিউইয়র্কে চিকিৎসা সবাইকে সরকারিভাবে দেয়া হয়।
আলাদা করে কারো চিকিৎসা দেবার সুযোগ নেই। এটিই সত্য। কিন্তু এই মহামারীর সময়ে যারা বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তাদের কাউকে গিয়ে যদি বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়া হয় তাতেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়না।
অতএব তুমি বাংলাদেশ যাচ্ছো, দাঁড়াও। নাম কামাবা? দাঁড়াও! তোমার নামে খন্দকার আছে। অতএব তোমাকে খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে আর রশিদের খালাতো ভাই বানিয়ে দিলাম!
এভাবে আমার ধারনা ডাঃ ফেরদৌসের সমস্যার সূতিকাগার নিউইয়র্ক। এক্ষেত্রে আমাদের সবার প্রিয় সিনিয়র সাংবাদিক ভাইকে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। বিদেশের এই দ্বন্দ্বগুলো সম্পর্কে আমরা জানি বলে সতর্ক থাকি।
দেশে বসে আমাদের সবার চেহারা জানা বোঝা সম্ভব নয়। এবং এসবের শিকার বাংলাদেশের একজন প্রবাসী ডাক্তারকে সাইজ করতে নিয়ে যাওয়া হলো কোয়ারিন্টানে! যদি স্বাভাবিক অবস্থা থাকতো ফিরতি ফ্লাইটে তুলে দিলেও অবাক হতেন কী!
কি বাজে অবস্থা দেশের। এত মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছেনা। প্রবাসী ডাক্তারের সময়ওতো অফুরন্ত নয়। তিনি যদি পাঁচজন রোগীকে সার্ভিস দিতে পারতেন তাতেওতো এই পাঁচটি পরিবারের উপকার হতো।
বিদেশে থাকলেও আমাদের মনটা সারাক্ষন পড়ে থাকে দেশে। কত বড় আশা নিয়ে আমরা দেশে যাই। দেশ থেকে পাওয়া যে কোন কষ্ট কত বেদনার তা প্রবাসী ছাড়া কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়।
সোমবার চীন থেকে যে সব ডাক্তার এসেছেন তাদের সামনে কী কোয়ারিন্টান শব্দটা উচ্চারন করতে পেরেছেন? খুব দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ছাত্রলীগ করা একজন ডাক্তার। তাঁকে কোয়ারিন্টানে নেবার পর লেখা হচ্ছে ইনি ভয়ংকর মিশন নিয়ে এসেছিলেন!
প্লিজ এসব থামান। এই বিপদে কে কিভাবে আমরা দেশের মানুষের কাজে লাগতে পারি সে চেষ্টা আপনি যেমন করছেন আরেকজনকে বাধাগ্রস্ত করলে তাতে দেশেরই ক্ষতি। দূঃখিত ডাঃ ফেরদৌস। আমাদের এই ভ্রাতৃঘাতী ভুল বুঝাবুঝি সারাজীবন থাকবেনা।