ফজলুল বারী: বুধবার বাংলাদেশে একদিনে সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। ১৭ হাজার ৫২৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে জানা গেছে তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৮ জন করোনা আক্রান্ত। নতুন করে মারা গেছেন ৪৩ জন।
এতে করে বাংলাদেশের করোনা রোগী লাখ ছাড়াবে আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে! কারন এখন পর্যন্ত সীমিত পর্যায়ের টেস্টের মাধ্যমে বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশে ৯৮ হাজার ৪৮৯ জন করোনা রোগী অফিসিয়েলি চিহ্নিত হয়েছে।
প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ লাখ ৪১ হাজার ২৪৪ জনের করোনা টেস্ট হয়েছে! আর আড়াই কোটি মানুষের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় করোনা টেস্ট হয়েছে ২৬ লাখের বেশি মানুষের।
অস্ট্রেলিয়ায় এখন পর্যন্ত ৭ হাজার ৩৬৭ জন করোনা রোগী পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৬ হাজার ৮৭০ জন সুস্থ হয়ে গেছেন। মারা গেছেন ১০২ জন। আর বাংলাদেশের মৃত্যুও হাজার ছাড়িয়ে বুধবার পর্যন্ত এই সংখ্যাটি ১ হাজার ৩০৫।
অথচ টেস্ট সামর্থ্য না থাক, এ নিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা আমলাতন্ত্রের দুষ্টামি অথবা দূর্বৃত্তপনা থামছেইনা! গণস্বাস্থ্যের টেস্ট কিট নিয়ে কাজ করতে দিলে দেশ কী ধংস হয়ে যাবে? মানুষ টেস্ট করাতে চাইছে।
সরকার সে সার্ভিস দিতে পারছেনা। কিন্তু গণস্বাস্থ্যের টেস্ট কিট নিয়ে জুতা আবিষ্কারের গল্পের মতো ‘এই না সেই’ বলেই চলেছে পারিষদবর্গ! করোনা টেস্ট নিয়ে সারাদেশের মানুষের ভোগান্তি দেখেশুনে আপনি অসহায়ের মতো শুধু কাঁদতেই পারবেন।
সরকারি ব্যবস্থা বাংলাদেশে যদি দক্ষ, সবক্ষেত্রে গণবান্ধব হতো তাহলে এদেশের এনজিও কার্যক্রমের দরকার পড়তোনা। সরকারি ব্যাংকে গিয়ে মনমতো সার্ভিস পাওয়া যায়না বলেইতো বাংলাদেশের মানুষ বেসরকারি ব্যাংকে ভিড় করে।
টেলিটক যদি গনবান্ধব সার্ভিস দিতে পারতো তাহলে গ্রামীনদের গ্রাহক সংখ্যা কি এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে? ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায়। টেস্ট সামর্থ্যের অভাবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ নীচের দিকে।
দেশে টেস্টের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে রোগী শনাক্ত বেশি দেখে অনেকে খুশি হয়ে উঠতে পারেন! কারন তারা অনেক লাশ আশা করছেন। অবাক এক দেশ! যারা সরকারকে পছন্দ করেননা তারা শুধু সরকার জব্দ হবে এই আশায় চান দেশবাসীর লাশ!
এই পক্ষ আগে বলতেন টেস্ট কম হচ্ছে বলে রোগীর আসল সংখ্যা জানা যাচ্ছেনা। কিন্তু আমার ধারনা সংক্রমনের শিকার রোগীর সংখ্যা অফিসিয়েল শনাক্তকৃত রোগীর চেয়ে খুব বেশি হবেনা।
সংক্রমন-রোগী অনেক বেশি হলে তারা এতোক্ষনে মরে ডোম হয়ে যেতেন। কিন্তু বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা তাদের খুশি হবার মতো হবেনা। কারন বাংলাদেশের মানুষের প্রতিরোধ সক্ষমতা অনেক বেশি।
সাধারন শীতে বাংলাদেশের কত সংখ্যক মানুষ ফ্লু ভ্যাকসিন নেন? বিদেশ যাবার সময় কয়জন নেন ট্র্যাভেল ভ্যাকসিন? বা এসবের কথা তারা জানেন? কত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কত ভেজাল খেয়ে টিকে বেঁচে থাকে আমার দেশের মানুষ!
এই যে সংক্রমন এত বেড়ে গেলো এর কারন গার্মেন্টস শুধু নানাকিছু আগেভাগে খুলে দেয়া, লোকজনের ঈদ সংখ্যা বাড়ি যাওয়া আসা এবং মহামারীকে পরোয়া না করা দায়ী করা হয়। অনেকে সরকারি নানা সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট।
কিন্তু আমিতো সরকারের সামর্থ্য সম্পর্কে ধারনা করতে পারি। এখন বাংলাদেশে মানুষ মরতে পারতো দুইভাবে। মহামারীতে এবং অনাহারে। অনাহারে মৃত্যু একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্যে অনেক বেশি স্পর্শকাতর।
আমার ধারনা সরকার একটা ঝুঁকি নিয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার এক পত্রিকায় একটি ছবি দেখে আবেগতাড়িত হয়ে সংশ্লিষ্ট ফটো সাংবাদিককে ফোন করেছিলাম। ছবির পঞ্চাশোর্ধ নারী ঢাকার বাসাবাড়িতে কাজ করতেন।
এখন কাজ হারিয়ে রাস্তার পাশে হাত পাততে বসেছেন। সংক্রমনের ভয়ে এখন অনেকে বাসাবাড়ির কাজের মানুষ, গৃহশিক্ষক এসবও বাদ দিয়েছেন। ওই ফটো সাংবাদিক বললেন শুরুর দিকে মানুষ যেমন সহায়তা দিচ্ছিলেন সেটিও এখন কমে এসেছে।
আসলে কমে এসেছে মানুষের সামর্থ্য। জমা টাকায় আর কার কয়দিন চলে। লোকজন বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে অনেকে গ্রামেও চলে যাচ্ছেন। সরকারের সামর্থ্যের অবস্থাওতো আমরা জানি।
দেশে করদাতার সংখ্যা কম হওয়ায় সরকার মূলত ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে চলে। ব্যাংকের অবস্থাওতো এখন ভালো নয়। আয় কমে যাওয়ায় তারাই এখন কর্মচারীদের বেতন কমানো সহ খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
সৃষ্ট পরিস্থিতির কারনে দেশে দারিদ্রের হার আবার বেড়ে গেছে। বেকারদের মিছিলে দেশি বেকারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন প্রবাস থেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফেরা বেকারেরা। আগামী ছয় মাসে স্পষ্ট হবে অনেক সংকট।
এরপরও সীমিত সামর্থ্যে বাংলাদেশ যেভাবে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। কোথাও কোন কিছু থেমে নেই। চিকিৎসা সামর্থ্য বাড়ানোর নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ চলছে প্রতিদিন।
মানুষের এত ভাবলেষহীন বেপরোয়া আচরনের মধ্যেও, এত জনঘনত্বের দেশেও বাংলাদেশে তুলনামূলক আক্রান্ত, মৃত্যুর সংখ্যা কেন কম, এসব নিয়ে একদিন গবেষনা হবে। তবে এটাও কোন আত্মপক্ষও হতে পারেনা।
আমাদের একজন লোকও আক্রান্ত-মরবে কেনো। আমরা কলেরা, ডায়রিয়া, যক্ষা, ম্যালেরিয়া সহ নানান মরনব্যাধি দৃষ্টান্ত সহ নিয়ন্ত্রন করতে পেরেছি। এ তুফান ভারী দিতে হবে পাড়ি কান্ডারি হুশিয়ার।
দেশের বাইরে থেকে নানাকিছু নির্মোহভাবে দেখার চেষ্টা করি। এই মহামারীর সময় দেশের কোথাও মানুষের মানুষের ভিড় দেখলেই ভয় করে। জীবিকা রক্ষায় সবার আগে দেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে।
সেই গার্মেন্টস কারখানাগুলোর কোন না কোনটিতে এখনও প্রতিদিন বেতন-ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ হয়। আমার এক গার্মেন্টস মালিক বন্ধুকে ফোন করলে জবাব পাই, দেশে এত গার্মেন্টস কারখানা। এক দুটিতে বেতনভাতার সমস্যাতো থাকতেই পারে।
কিন্তু এই মহামারী ছড়াতেতো যে এমন এক দুটি জনসমাবেশই যথেষ্ট। একজন থেকে তিন জন, তিন জন থেকে নয় জন, নয় জন থেকে সাতাশ জন, এভাবে জ্যামিতিক হারে বেড়ে স্বল্পতম সময়ে রেড জোন হয়ে ওঠে একেকটি এলাকা!
একদিন লাল পতাকা ভয় পেয়েছে পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং বাংলাদেশ! বলা হয়েছে, লাল পতাকার রাজ্যে গণতন্ত্র থাকেনা, মানুষের কথা বলার অধিকার থাকেনা, আল্লা-খোদা থাকেনা, সবাই নাস্তিক হয়ে যায় লাল পতাকার রাজ্যে!
আর এই মহামারীর সময়ে তারাই লাগাচ্ছেন রেড জোন সাইন-পতাকা! গলির মোড়ে লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে! বলা হচ্ছে মানুষকে ঘরে রাখতে হবে আর তাদের হাতে খাবার আর টাকা পৌঁছে দিতে হবে।
এমন মহামারী দেখলে একটি পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির সরকারের কাছে সবাই চায় সমাজতান্ত্রিক সরকারের সুযোগ সুবিধা! এই সময়ে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা হিসাব নিকাশ হয়ে গেছে এলোমেলো-গোলমেলে!
এমন সব অসামঞ্জস্য আর মৃত্যুর মিছিলের মাঝখানে দাঁড়িয়েও আমি অবাক দেখি আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ একজন সর্বক্ষনিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহামারী মোকাবেলায় দারুন এক ফাইট দিচ্ছে।
কারন যে সব দেশ এরমাঝে বিপুল মৃত্যুর মিছিল পাড়ি দিয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও বাংলাদেশের মতো ভঙ্গুর নয়। বাংলাদেশের একটি হাসপাতালে হয়তো একটি অপারেশন থিয়েটার-চার-পাঁচটি আইসিইউ বেড থাকে।
এই একটি অপারেশন থিয়েটারই হাসপাতালের সব বিভাগ চেয়ে চিন্তে ব্যবহার করে। আর উন্নত দেশ যারা আক্রান্ত সংখ্যা আর মৃত্যুর মিছিল নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারেনি তাদের প্রায় সবার হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগের আছে আলাদা অপারেশন থিয়েটার।
বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যায় আইসিইউ, ভেন্টিলেটরও নেই। যা কিছু অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল এর বড়অংশ তেল-পিঁয়াজ-লবন বেশি কিনে মজুদের মতো অনেকে কিনে বাড়িতে নিয়ে তুলেছেন!
যদি কখনও করোনা হয় এই আশংকায় অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে মজুদদারদের কারনে এখন যাদের অক্সিজেনের জরুরি দরকার তাদের অনেককে অক্সিজেন দেয়া যায়নি! নইলে এই মৃত্যুর সংখ্যাও আরও কম হতো।
যে যেখানে যার পরিচিত তাকে বুদ্ধি দিয়ে প্রয়োজনে অর্থ দিয়ে ঘরে রেখে আরও কিছুদিন চেষ্টা চালিয়ে গিয়ে একটা রেজাল্ট আসবেই। ঢাকার নতুন দুই মেয়রও অনেক সিরিয়াস। রেজাল্ট আসবেই।
ছবির কাহিনীঃ করোনাভাইরাস পরীক্ষার নমুনা দিতে বিপাকে মানুষ। সিরিয়াল পেতে হাসপাতালের সামনের ফুটপাত ও ঘাসের ওপর সারা রাত মানুষের অবস্থান। প্রতিদিন নমুনা সংগ্রহ করা হয় ৪০ থেকে ৫০ জনের। কিন্তু নমুনা দিতে প্রতিদিন লাইনে থাকেন দুই শতাধিক মানুষ। সোমবার রাত সোয়া একটায় গাজীপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজের সামনে। ছবি: সাজিদ হোসেন/প্রথম আলো