যার ধর্ম তার কাছে রাষ্ট্রের কি বলার আছে

যার ধর্ম তার কাছে রাষ্ট্রের কি বলার আছে

ফজলুল বারী: এরশাদ যখন ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষনা করে ‘যার ধর্ম তার কাছে রাষ্ট্রের কী বলার আছে’ শ্লোগানটি তখন খুব জনপ্রিয় হয় বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি সহ আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিলে শোনা যেত এক শ্লোগান।

মুক্তিযুদ্ধের আগে শ্লোগান ছিল ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’। ‘বাংলার হিন্দু বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’। এখনকার রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের কথা বললে কি তখন এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় পায়?

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়ও দেশের মানুষের মন অনেক পবিত্র ছিল। সে জন্যেইতো মুক্তিযুদ্ধের পর এত নূর হোসেনরা তখনও প্রান দিতে আসতো মিছিলে। এরপর যে মানুষগুলো প্রতারিত হলো! আর তারা মিছিলে সেভাবে আসেনা।

এখন দিন দেখে অনেক হাইব্রিডও মিছিলে আসে। এসেই এরা ফেসবুকে লাইভ দেয়। সেলফি আর ছবির পোষ্ট দিয়ে তাদের অনেকে টাকা গুনতে চলে যায়। কোথাও প্রান নেই। উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মারতে আসে! ওই মিয়া আপনে মুসলমাননা?

রাষ্ট্র ধর্ম নিয়ে কথা বলেন! দেশে উত্তেজনা ছড়াতে চান! বঙ্গবন্ধুও এই রাষ্ট্র ধর্মের জন্যে প্রান দিয়েছেন জানেননা? আসলে এরা অনেক কিছুই ঠিকমতো জানেনা। এখন তাদের জানতে হয়না। সহমত ভাই জানলে বললেই চলে!

অথচ এরশাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ধর্মের আন্দোলনটি সবার হয়ে ওঠার কারন তখন এ দাবিটি কারও ছিলোনা। মূলত তখনকার উত্তাল গণআন্দোলনকে বিপদগামী করতে ওই ধর্ম কার্ডটি ব্যবহার করে এরশাদের চিহ্নিত ভন্ড এক স্বৈরাচারী। ।

তখন এমন আরও অনেক ধর্ম কার্ড খেলতো এই অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী বহুগামী স্বৈরাচারী। অথচ তার দৈনন্দিন জীবন কর্মসূচি-আমলনামায় ধর্মের লেশমাত্র ছিলোনা। এরশাদ তখন এক জুম্মার নামাজ এক শুক্রবারে ঢাকার এক মসজিদে পড়তেন।

আর নামাজের আগে মুসল্লিদের উদ্দেশে দিতেন মিথ্যা বক্তৃতা! সেটি নিয়ে নিউজ হতো। এরশাদ বলতেন আগের রাতে তিনি এই মসজিদে নামাজ পড়ার স্বপ্ন দেখেছেন! তাঁর কথায় তখন মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন-মুসল্লিরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতেন!

কারন রাষ্ট্রপতি তাদের মসজিদে আসবেন এটা তারা বেশ আগে থেকে জানতেন। এরজন্যে আগের কয়েকদিন ধরে মসজিদের নিরাপত্তা দেখভাল করতো গোয়েন্দারা। আর আমরা সাংবাদিকরা মজা পেতাম ভিন্ন কারনে।

কারন আমরা তখন করতাম তার স্বৈরাচারের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কেরও অনুসন্ধান! তখন সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এরশাদের ‘তিরিশ সেট অলংকার’ লিখে নিষিদ্ধ হয়েছিল। সংরক্ষিত আসনের সেই তিরিশজন মহিলা এমপি এরশাদ নিজে ঠিক করতেন।

যায়যায়দিনের অভিজ্ঞতায় আমরা কখনোই তাদের আর তিরিশ সেট অলংকার লিখিনি। ইন্টারভ্যু করে করে উন্মোচন করতাম এরশাদের সেই বান্ধবীদের মুখোশ। জিনাত মোশাররফকে নিয়ে লেখায় তখন বিপদেও পড়ে যাচ্ছিলাম।

এরশাদের গোয়েন্দারা তাদের স্যার আমার সঙ্গে চা খাবেন বলে অফিস থেকে তুলে নিয়ে যায়। অফিসে তখন একা থাকায় কাউকে বলেও যেতে পারিনি। আমাকে তিনি ধমকের সুরে বলেন ‘এসব লিখেছেন কেনো’।

‘এসব লিখলে আমাদের অসুবিধা হয় বোঝেননা। আর লিখবেননা’। আমি জবাব দিয়ে বলি, ‘ঠিক আছে আর লিখবোনা। কি করে আর লিখবো। তথ্য যা ছিল সবতো লিখে ফেলেছি’। সেই ‘স্যার’ তখন হ্যাঁ তাকিয়ে থাকেন।

ভাগ্যিস তখন এই ৫৭ ধারা ছিলনা। তখন সাধারনত আটকানো হতো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে। হাইকোর্টে রিট করলে বেরিয়ে আসা যেত। সেই কর্মকর্তাকে এখন টেলিভিশনে ভালো ভালো কথা বলতে দেখি। ভালোই লাগে।

আর ভাবি ‘চাকরিটা তার তখন বড় দরকার ছিল শুনছো’! সেই পাকিস্তান আমল থেকে এই তল্লাটে এমন অবৈধ ক্ষমতা দখলদাররাই এ অঞ্চলের ধর্ম প্রচারক! সেই থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি বহাল।

ধর্মীয় নেতারা নির্বাচনে জিতে কিছু করেছেন এমন নজির নেই। কিন্তু তারা নিত্য এই করে ফেলবো সেই করে ফেলবো করে হুমকি দিতে পারদর্শী। ক্ষমতা দখলকারী সামরিক ব্যক্তিরাই তাদের অবৈধ ক্ষমতা জায়েজ করতে বরাবর খেলেছেন ধর্ম কার্ড।

এই প্রজন্মতো এসব জানেনা, তারা কিভাবে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে তখন রেডিওতে ক্ষমতা দখলের ঘোষনা দিতেন! রেডিওতে তখন বাজতো শুধু হাম-নাত আর ধর্মীয় সঙ্গীত! ‘আ-ল্লা-হ ক-রো-না বিচার’!

যেন মানুষ খুন করে ক্ষমতা দখল করে একেকজন কি দারুন সওয়াবের কাজ করে ফেলেছেন! ধর্মীয় নেতারাও এসে তাদের প্রতি সমর্থন ঘোষনা করতেন। খুনিদের পক্ষে মুনাজাত করতে করতে আবেগে কেঁদে ফেলতেন।

এমন এক ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের মুসলিম পারিবারিক আইনটির প্রবক্তা। উঠতি ঠিকাদাররা তার ভক্ত ছিল। কারন ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবন সহ আরও অনেককিছু তখন বানানো শুরু হয়।

কিন্তু আগরতলা মামলার নামে বঙ্গবন্ধুকে শায়েস্তা করতে গিয়ে সে শায়েস্তা হয়ে যায় নিজেই। তার পতন ঘটানো হয় গণঅভ্যুত্থানে। ধর্ম ব্যবসা তার পতন আটকাতে পারেনি। এরপর সারাক্ষন সুরা আর সাকি লোভী জেনারেল ইয়াহিয়া আসে ক্ষমতায়।

ধর্মের নামে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ দমনের নামে রক্তগঙ্গা চালিয়েছে এই মদ্যপ জেনারেল। ধর্মের নামে তিরিশ লাখ মানুষ হত্যা করেছে সেই শ্বাপদ শয়তান। তার সঙ্গী জেনারেল সবক’টাও ছিল নারী লোভী-মদ্যপ।

এদের সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার। পচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আবার খেলা হয় ধর্ম কার্ড।

জাতির স্বাপ্নিককে খুন করে রেডিওতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় চারনীতি থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ভুলন্ঠনের শুরু তখন থেকে। বাংলাদেশটাও তখন শুধু পিছনে হাঁটতে থাকে।

খুনিদের অন্যতম কর্নেল ফারুক বিচিন্তার সাক্ষাৎকারে বলেছিল মুসলিম প্রধান দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার অপরাধেই তারা শেখ মুজিবকে শাস্তি দিয়েছে। জিয়া ক্ষমতা নিয়ে প্রথম ভাষনের জানান দিলেন তিনি ‘বিসমিল্লাহ’রও শুদ্ধ উচ্চারন জানেননা!

করাচিতে বড় হওয়া জিয়া বলতেন ‘বেসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’! কিন্তু জিয়ার ধর্ম-কর্মের খবর তার ঘনিষ্ঠরা জানতেন। বাংলাদেশের প্রতিটা মুসলমান ঈদে-শবেবরাতে তাদের বাবা-মা’র কবর জিয়ারত করেন। একমাত্র জিয়া এটি করতেননা।

খালেদা জিয়াও জানাজানির ভয়ে কোন দিন তার শশুর-শাশুড়ির কবর জিয়ারতে যাননি। কারন তাদের কবর যে পাকিস্তানের করাচিতে। জাতির পিতাকে হত্যার পর তাঁর নাম নিষিদ্ধ করে রাখে জিয়া! বিচার করতে দেয়নি!

এসব কী ইসলাম ধর্মের শিক্ষা? তা আপনি জড়িত না, কিছুই জানেননা বিচার করতে দিলেননা কেনো? এই প্রজন্মকে যে সব গল্প খাওয়ানো যায়না পাঞ্জেরি। জিয়া আইন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিষিদ্ধ করে রাখেন সংবিধানে।

সেই পঞ্চম সংশোধনীতে বিসমিল্লাহ সংযোজনের কার্ডও খেলেন জিয়া। ‘বিসমিল্লাহ বলে জাতির পিতাকে হত্যা করিলাম’! জিয়ার সেই ধর্ম কার্ডের ষোলকলা পূর্ন হয় তার মুরিদ এরশাদের রাষ্ট্র ধর্মে! সে অনেক শয়তান চতুর।

হঠাৎ তার মনে হলো জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় পাখি দোয়েল আছে। জাতীয় খেলার নাম হাডুডু। কিন্তু আমাদের একটা যে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় ধর্ম নেই! আহা! অতঃপর বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম প্রকাশ্য বহুগামী এরশাদ করলেন রাষ্ট্রধর্ম!

ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের অষ্টম হিসাবে সংবিধানে অঙ্গীভূত করে শাসনতন্ত্রের অষ্টম সংশোধনী আইনের সঙ্গে হাইকোর্টের বেঞ্চ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। কারন উকিলগুলো সব ঢাকায় বসে ঘোট পাকায়!

ক্ষুদ্ধ উকিলরাও এর বিরুদ্ধে মামলা করলেন সুপ্রিমকোর্টে। বিচারকরা অষ্টম সংশোধনীর হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থানান্তরের অংশ বাতিল করলেন। রাষ্ট্র ধর্মে হাত দিলেননা। তাদেরও তখন হাত কেঁপেছে! যদি মিস হয়ে যায় বেহেস্তের ট্রেন!

বাংলাদেশের কে না বেহেস্তে যেতে ভালোবাসে! কতকিছু সেখানে আছে বলা আছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থে! এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিজয়ী নেত্রী ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসা খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেও হাত দেননি রাষ্ট্রধর্মে। বেহেস্তে তারও যাওয়া চাই।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বলা হলো সংবিধানে হাত দেবার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা এসেছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে তৎপর হয় সংবিধান সংশোধনী কমিটি।

এই কমিটি তখন ভীষন ব্যস্ত। নানান বিজ্ঞজনের বক্তব্য নিচ্ছিল। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তও প্রতিদিন মিডিয়ায় বলছিলেন, আমরা এই করবো সেই করবো। অতঃপর একদিন ধমক খেয়ে তিনিও হয়ে গেলেন বাক বাকুম পায়রা। অর্থাৎ কেউ কথা রাখেনি।

সেই থেকে বিসমিল্লাহ-রাষ্ট্রধর্মে মোড়ানো দেশের কী কোন নৈতিক উন্নতি হয়েছে? সেই রাষ্ট্র ধর্মের আগে কী দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজন মুসলমান ছিলেননা?

তারা কী তখন ধর্মকর্ম করতেননা? বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসার শাড়িপরাও ছিল কত শালীন-সুন্দর। এখনতো সবাই বলেন, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। নানা পাপাচারে পথ হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তভেজা ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ।

একদার বড় ভালো দেশটাকে দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন করা হয়েছে। এখন চারপাশে শুধু হাইব্রিডদের দাপট, হিজাব-রোজা রেখে বিসমিল্লাহ বলে প্যাকেট নেবার গল্প! বিদেশে হাজার হাজার টাকা পাচারের ফিসফাস!

এসবকে কী বিসমিল্লাহ আর ধার্মিকদের দেশ বলা যাবে পাঞ্জেরী? অস্ট্রেলিয়া আসার পর থেকে দিনে দিনে বুঝতে পারি আমরা যে শ্লোগান দিতাম ‘যার ধর্ম তার কাছে রাষ্ট্রের কি বলার আছে’ এটা সেই দেশ। এখানে সব ধর্মের মানুষ আছেন।

কার কোন ধর্ম তা নিয়ে এই রাষ্ট্রের কোন মাথা ব্যথা নেই। এখানে সবাই যার যার ধর্ম পালন করেন। প্রতিবেশীর ধর্ম কী তা নিয়ে কেউ ভাবেনা। কাজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। কাজই ইবাদত। কাজই সব।

কারন বেশিরভাগ নাগরিকের কাজ করলে শুধু আয় হয়। কাজ নেই আয় নেই। সংসার চালাতে সপ্তাহে কমপক্ষে হাজার ডলার লাগে। এটি খ্রিস্টান প্রধান দেশ। কিন্তু মুসলিম বা বাংলাদেশী হিসাবে কখনও মনে হয়নি আমি-আমরা সংখ্যালঘু।

কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু, সমতলে পাহাড়ে আদিবাসী পাহাড়িরা, ভারতে মুসলমানরা টের পায় সংখ্যালঘুর হবার বিপদ। এখানে কোন মসজিদে মাইকে আজান হয়না। গির্জার ঘন্টা বা মন্দিরের কীর্তন-ঢোল-তবলার শব্দ বাইরে আসেনা।

যার যা খুশি ঘরের মধ্যে করো। ভিন্ন কেউ যাতে বিরক্ত না হয়। এখানে বেশিরভাগ লোক ধর্মে বিশ্বাসীও না। নাগরিকত্বের শপথ দুইভাবে হয়। ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে এবং ধর্মগ্রন্থ ছাড়া। ধর্মগ্রন্থ ছাড়া গ্রুপটি সংখ্যায় বড়।

রাষ্ট্রের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সেই যে একই সুর-যার ধর্ম তার কাছে। সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো মিথ্যা কথা বলা। একটা ফোন নেয়া থেকে শুরু করে সবকিছুতে ঘোষনা দিয়ে বলতে হয়-যা বলেছি সত্য বলেছি।

মিথ্যা ধরা পড়লে অনেক বিপদ। এখানে দুর্নীতি হয়তো উচ্চ পর্যায়ে আছে। নিম্ন পর্যায়ের লোকজন ঘুষ-দুর্নীতি-মিথ্যার বেসাতি মুক্ত। মানুষের কী অধিকার, মানবাধিকার এসব জানতে দেখতে আজকের অস্ট্রেলিয়া দেখতেই হবে।

এদেশের ধর্মভীরু খ্রিস্টানরাও আজকাল ধর্মকর্ম কম পালন করে। অথবা তাদের ধর্মীয় চর্চার দিকটাই সাপ্তাহিক। খ্রিস্টান নতুন প্রজন্মকে চার্চে আনতে বাস্কেটবল সহ নানান খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হয়। তবু তাদের আনা যাচ্ছেনা।

তাই চার্চগুলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। মুসলমানরা সেগুলো কিনে মসজিদ বানাচ্ছে। পৃথিবীর নানান দেশের মুসলমানরা এদেশে এসে থিতু হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি মুসলমান লেবাননের। তারা চল্লিশের দশক থেকে অস্ট্রেলিয়ায়। সংসদে তাদের এমপিও আছেন।

অস্ট্রেলিয়ায় কর্মক্ষেত্রে ধর্মকর্ম করা যায়না। প্রকাশ্যস্থানে ধর্মকর্মের আগে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুসলমানরা কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীকে ম্যানেজ করে নামাজ পড়েন। সংখ্যায় বেশি থাকলে নামাজ পড়েন জামাতেও।

মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের আকৃ্ষ্ট করতে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নামাজের আলাদা কক্ষ করে নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রী এদেশের রাজস্ব আয়ের বড় একটি উৎস। এরা নিজেরা ধর্মকর্ম না করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একজন ধার্মিককে শ্রদ্ধা করে।

এদেশে যেহেতু খ্রিস্টান স্কুল আছে সেহেতু মুসলিম স্কুলও আছে এলাকায় এলাকায়। সিডনির লাকেম্বার ওয়ানজি রোডের অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদের সামনের রাস্তায় বছরে অনুমতি নিয়ে ঈদের জামাতের ব্যবস্থা করা হয়।

এ উপলক্ষে আগের দিন থেকে সংশ্লিষ্ট রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে পুলিশ। দেশটি সরকারি-বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব ঈদের জামাতে বক্তৃতা দেবার সুযোগ হাতছাড়া করেননা।

এত মানুষের রেডিমেট সমাবেশে বক্তৃতা দেবার রেডিমেট সুযোগ। হাতের কাগজে লিখে আনা ‘হ্যাপি ঈদ মুবারক বলতেও ভোলেননা। চাঁদ দেখে-চাঁদ দেখা ছাড়া ঈদ যেহেতু একাধিক দিনে হয়ে এসব নেতারা তাই উভয়দিনেই বক্তৃতা দিতে আসেন।

এই করোনায় গত দুই ঈদে অবশ্য বড় কোন ঈদ জামাত হয়নি। রোজায় ঈদ জামাত বন্ধ ছিল। কুরবানির ঈদের জামাতে একসঙ্গে পঞ্চাশজনের বেশি জমায়েতের সুযোগ ছিলনা। রাজনৈতিক নেতাদেরও তাই ঈদ বক্তৃতা মিস।

করোনা সংক্রমন এড়াতে ইনডোরে তিরিশের কম মানুষের জমায়েতের সরকারি আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মসজিদ-গির্জা কমিটি সেগুলোয় তালা ঝুলিয়ে দেয়। এরজন্যে ঘরে কারও নামাজ পড়া বন্ধ হয়নি বা মুসলমানিত্বও খারিজ হয়ে যায়নি।

আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল জনগোষ্ঠীর এ দেশটায় করোনা সহ নানাকিছুতেও সহজে সামাল দেয়া গেছে। আইন অবজ্ঞা করলেই বড় জরিমানা। কিছু জরিমানার পরিমান ছিল বাংলাদেশের লক্ষ টাকার বেশি।

প্রশান্তপাড়ের দেশটায় এখন পর্যন্ত করোনায় কোন বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়নি। এখনও এখানে মসজিদ-মন্দির-গির্জায় একসঙ্গে পঞ্চাশ ব্যক্তির বেশি প্রবেশাধিকার নেই। মসজিদ মন্দির বা গির্জায় প্রবেশপথে এখনও নানান সতর্কতা।

কারন যে এখনও এই মহামারী রোগটির ভ্যাকসিন নেই। এখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ঢুকতেও তাপমাত্রা মাপা ছাড়াও নাম-ফোন নাম্বার লিখতে হয়। কারন কারও করোনা ধরা পড়লে এই তালিকা ধরে সহজে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা যাবে।

ধর্ম ভিত্তিক যে সব মানুষের সমান শান্তির দেশ গড়া সম্ভব নয় তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদরা জীবন দিয়ে আমাদের বলে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের মতো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। এই দেশ একদিন আদিবাসীদের নির্যাতন করেছিল।

সেই দেশের বর্তমান প্রজন্মের নেতৃত্ব সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছে, ‘উই আর সরি’। বাংলাদেশে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত সব মানুষের সমান অধিকারের দেশ গড়া না গেলে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তভেজা স্বপ্ন।

এখানে কোন চালাকির জায়গা নেই। চালাকির কোন সুযোগ নেই। আবার শ্লোগান হোক যার ধর্ম তার কাছে রাষ্ট্রের কি বলার আছে। তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি। বড়জোর বাংলাদেশের বাঙালি বলতে পারেন।

মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পরিনাম বিপদ ডেকে আনবে। শহীদের আত্মত্যাগের চেয়ে বড় ত্যাগ আমাদের নেই। এত রক্তদান বৃথা যাবেনা। যেতে পারেনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মিথ্যা হবেনা কোন দিন।

এক কসাই কাদের কেন্দ্রিক ক্রোধ থেকে শাহবাগ হঠাৎ এভাবে জয়বাংলাময় হয়ে উঠবে, তা কি আগে এমন সবাই ভেবেছেন? কাজেই সময়ের প্রয়োজনে জ্বলে ওঠা

তরুনরাই আমাদের বারবার পথ দেখাবে। আশ্রয় হবে।

দেশের স্বাধীনতার জন্যে পাগল তরুনরাই একাত্তরে যুদ্ধ করেছে। শহীদ হয়ে দিয়ে গেছে সব ধর্মের মানুষের জন্যে নিরাপদ একটি দেশ। শহীদের রক্তের দায় থেকে পিছিয়ে আসার পথ নেই।

টুডে অর টুমোরো আজ বা আগামীতে যখনই হোকনা কেনো বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের রক্ত শপথ ধর্ম নিরপেক্ষতায় ফিরতেই হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো এটাও করতে হবে আওয়ামী লীগকেই। এটাই ফাইনাল কথা।