ফজলুল বারী: আমি তখন সারাদেশ পায়ে হেঁটে ঘুরে ঢাকায় এসেছি। পিঠের ব্যাগটাকে হ্যাভারশেক বললে ভুল হবে। ঝোলা বলাই ভালো। হ্যাভারশেক বলতে যা বোঝায় তা তখন এতটা প্রচলিত অথবা সহজলভ্য ছিলোনা। তা কেনার সামর্থ্যও ছিলোনা আমার। ঝোলার মতো ব্যাগটি পথে কেউ একজন বানিয়ে দিয়েছিলেন।
একজন সাইনবোর্ড লিখিয়ে দিয়ে লিখে দেয়া হয় বাংলাদেশ ভ্রমন। ঢাকায় এসে একদিন সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি। সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে সাইকেলে বিশ্বভ্রমনে যেতে আমি তাদের কাছে কাগজপত্রের প্রশাসনিক সাহায্য চাইলাম। আমি তখন সবকিছু হয়ে যাবার স্বপ্ন দেখি।
তারা আমাকে কিছুদিন পর আবার যেতে বলেন। আমি ভাবলাম এই সময়ে যদি কোন পত্রিকায় লেখালেখির সুযোগ পাওয়া যায়। নয়াপল্টনে আজকে যেটা গাজী ভবন সেখানে পুরনো একটি শাদা রঙের দোতলা ভবন ছিল। সচিত্র সন্ধানীর অফিস ছিল সেখানে।
নীচতলার একটি কক্ষে একটি টেবিলকে ঘিরে কয়েকজনের আড্ডা চলছিল। আড্ডার মূল চরিত্রের নাম জেনেছি পরে। সুশান্ত মজুমদার। ছোট গল্পকার। তখন সম্ভবত তিনিই সন্ধানী দেখাশুনা করতেন। পিঠে ঝোলাওয়ালা আগন্তুক দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই।
আমি আমার আগমন উদ্দেশ্য সংক্ষেপে বললাম। পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমন করে ঢাকা এসেছি। এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা করেছি সারাদেশে। এখন কোন একটি পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক করতে চাই। হো হো করে হেসে উঠলেন সুশান্ত মজুমদার।
সারাদেশের লোকজন আমার কিছু খাতায় তাদের মন্তব্য লিখতেন। সেগুলো একেকটি দিনে দিনে ঢাউস আকার নেয়। আমাকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার পত্রিকায় ছাপা রিপোর্ট কেটে সেগুলোয় আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখতাম। লোকজনের মনোযোগ পেতে এসব হাতে ধরিয়ে দিলে লোকজনের দেখতে পড়তে ভালোই লাগতো।
কারন সবার মাঝেই একজন পর্যটক অথবা ভবঘুরে মন আছে। সবাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। তেমন একটি খাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে সুশান্ত মজুমদার মজা করেন, আপনি আমাদের সঙ্গে কি রকমের সম্পর্ক করতে চান? শারীরিক সম্পর্ক? বৈবাহিক সম্পর্ক? না অর্থনৈতিক সম্পর্ক?
তার কথায় আড্ডার সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন। মন খারাপ হয়ে গেলো। ঢাকা আসার পর থেকে এমনিতে আমার মন খারাপ। পর্যটক হিসাবে সারাদেশের মানুষের কাছে অনেক আদর-যত্ম পেয়েছি। কিন্তু ঢাকা শহরে আসার পর কোথাও কোন পাত্তা পাচ্ছিনা। তবু সেখানে বসে থাকি।
সুশান্ত মজুমদার অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে সেই আড্ডার একজন আমাকে বাইরে নিয়ে যান। একটা সিগারেট ধরিয়ে হাত বাড়িয়ে আমাকেও অফার করেন। আমি তখনও সিগারেট খাইনা। ভদ্রলোক না বলে তাকে তুমুল তরুন বলাটা যথাযথ হবে। হ্যান্ডশেক করতে করতে বলেন, আমার নাম মিনার মাহমুদ। আপনি আমার নাম শুনেছেন?
বললাম, না। মিনার মাহমুদ বললেন, আমি এক সময় বিচিত্রায় কাজ করতাম। আপনি আমার লেখা পড়েছেন? বললাম, না। এরপর আমাকে বলেন, আমি বিচিন্তা নামের একটি পত্রিকার জন্যে আবেদন করেছি। কিন্তু ডিক্লারেশন পাচ্ছিনা।
আপনাকে দেখে মনে হলো আপনাকে নিয়ে আমরা বিচিন্তা নিউজ এজেন্সি নামে একটা কিছু করতে পারি। সেখানে আপনি আপনার সারাদেশের অভিজ্ঞতা লিখবেন। সেগুলো আমরা দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় বিক্রি করবো। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী আমাদের সঙ্গে কাজ করতে রাজি?
এই প্রথম ঢাকা শহরে কেউ আমাকে পাত্তা দিলো। আমি তাকে বললাম, আমি তার সঙ্গে কাজ করতে রাজি আছি। আমাকে ৪১/১ দিলুরোডের একটা ঠিকানা দিয়ে বললেন, কাল সকালে আসুন। আমরা আরও গল্প করবো।
পরদিন সকালে ঠিকানামতো চলে গেলাম। একটি ভবনের নীচতলার এক কোনে ছোট দুইকক্ষের বাসা। আমি একটা দরজায় নক করতেই এক অপরূপ সুন্দরী নারী দরজা খোলেন। কবিতা ভাবী। মিনার ভাই আসতে বলেছেন বললে আমাকে তিনি অপর দরজায় যেতে বলেন।
বুঝতে পারি যে দরজায় আমি নক করেছি সেটি তাদের শয়ন কক্ষ। অপর দরজায় যেতে দেখি সেখানে একটি বিছানায় শুয়ে আছে মিনার মাহমুদ। আমাকে তিনি বললেন, রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। তিনি একটু ঘুমাবেন। আমি এই সুযোগে দিনের পত্রিকাগুলো পড়ে নিতে পারি।
তখন খুব বেশি দৈনিক পত্রিকা ছিলোনা। সবগুলোই সেখানে ছিল। সব পড়তে আমার ভালোই লাগছিল। তখনকার প্রায় সব সাপ্তাহিক পত্রিকাও ছিল। মিনার মাহমুদ ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নিলেন। বললেন, চলেন এক জায়গায় যাই। আমি তার মোটর সাইকেলের পিছনে বসেছি।
এটি বিচিন্তা পাঠকদের কাছে পরিচিত সেই লাল মোরগের মতো মোটর সাইকেল। মিনার মাহমুদ যেভাবে চালাচ্ছিলেন আমি বারবার আমি তার পিঠে গিয়ে পড়ছিলাম। তার বেশ কমান্ডিং ভয়েস। আমাকে তিনি বলছিলেন, এভাবে বসতে হয়না। এভাবে বসতে হয়।
ধানমন্ডির পাঁচ নাম্বার সড়কের একটি বাড়িতে আমরা গিয়ে থামি। নীচতলার কক্ষে টেবিলের ওপাশে বসা এক ভদ্রমহিলা। এ পাশে বসা অভিনেতা আফজাল হোসেন। তিনি ছবিও আঁকেন। পত্রিকায় শিল্প নির্দেশকের কাজও করেন আফজাল। আড্ডায় তেমন কিছু নিয়ে আলাপ হচ্ছিল।
কিন্তু আমার সঙ্গে কেউ কোন কথা বলেননা। আমি বসে বসে পত্রিকা পড়ি। পরে শুনেছি এটা আমার ইন্টারভ্যু ছিল। ভদ্রমহিলা আমাকে দেখতে উৎসাহী ছিলেন। সারাদেশ পায়ে হেঁটে ঘুরে এসেছে। ছেলেটা দেখতে কেমন। ভদ্রমহিলার নাম লতা হোসেন। তার একটি ওষুধ কোম্পানি ছিল। বিচিন্তা তার টাকায় বেরোয়।
মিনার মাহমুদ আমাকে বদরুল ডাকতে শুরু করেছেন। আমার ডাক নাম। আমি তাকে ডাকতে শুরু করেছি মিনার ভাই। আমাকে এক পর্যায়ে তিনি খাবার ঘরে নিয়ে আসেন। আমাকে বললেন আপনার নিশ্চয় টাকা দরকার। আপনি খেয়ে নিয়ে এখান থেকে আবার দিলু রোডে চলে যাবেন।
আপনার ভাবীকে চিঠি লিখে দিচ্ছি। ও আপনাকে দু’শ টাকা দেবে। এভাবে কাজ শুরু আমার মিনার মাহমুদের। সেই দু’শ টাকাই ঢাকার মিডিয়ায় আমার প্রথম রোজগার। আজ ২৯ মার্চ তাঁর চলে যাবার দিন। আমি তখন অস্ট্রেলিয়ায়। ভালো থাকবেন মিনার ভাই। -ইতি আপনার বদরুল