ফজলুল বারী: শেখ হাসিনার দেখানো পথ ধরে এখন প্রতিদিন বাড়ছে বিএনপির ঢাক গুড়গুড় গরম বক্তৃতা! আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামের বক্তৃতায় শেখ হাসিনা আভাস দিয়েছিলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বাধা দেয়া হবেনা।
এরপর থেকে বিএনপির নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাসগং প্রতিদিন সরকারকে এই করে ফেলবো সেই করে ফেলবো বক্তৃতা দিচ্ছেন। আবার তারা এমনও বক্তৃতা দিচ্ছেন শেখ হাসিনা তাদের দল ভাঙ্গতে পারবেননা। শেখ হাসিনা তাদের দল ভাঙ্গার চেষ্টা করছেন, এমন তত্ত্বও কেউ এখনও জানেনা।
শ্রীলংকার ঘটনাবলীতেও চাঙ্গা আছেন বিএনপির অনেক নেতা–কর্মী। এর আগে ভারতে বিজেপির ক্ষমতায় আসা নিয়ে এ দল অনেক খুশি করেছিল। খুশিতে আটখানা বিএনপির নেতা শামসুজ্জামান দুদু মিয়া তখন হুংকার দিয়ে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা কবে যাবে সেটিই এখন তাদের ক্ষণ গণনার পালা।
বিএনপি সমর্থন একটি পত্রিকা কল্পগল্প লিখে বলেছিল লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের সঙ্গে বিজেপির খায়–খাতির কত মধুময়। সেই সময় এক রাতে খালেদা জিয়ার বাসায় ফোন করেছিলেন বিএনপির নেতা হান্নান শাহ। হান্নান শাহকে অমিত শাহ বলে ভুল করে খালেদা জিয়ার মিডিয়া টিম!
মিডিয়া সেলের মারুফ কামাল খবর প্রচার করেন, বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা জানতে ফোন করেছিলেন। এ নিয়ে অমিত শাহ’র সঙ্গে যোগাযাগ করলে তিনি জবাব দেন, ‘ইয়ে ঝুটা হ্যায়, বিলকুল ঝুটা হ্যায়’! কহি বেসিস নেহি’। অর্থাৎ বিএনপির দাবি ভূয়া।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন ট্রল হয়, ‘অমিত বললো লাবন্য’র সঙ্গে তার কথা হয়নি’! এসব কয়েক বছর আগের কথা। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে বিজেপি সরকারের অবিরাম সমর্থনে ক্ষুব্ধ হয় বিএনপি। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ঢাকা সফরের দিন হরতাল দেয়াকে ভারত ভুলে যায়নি।
প্রণব কংগ্রেসের নেতা হলেও রাষ্ট্রপতি হিসাবে যে সারা ভারতের তা ভাবতে বিএনপি ভুল করেছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরেও বিএনপির মন্ত্রী–কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফর করে তাদের বার্তা দিয়ে যান। বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধীদল হয়।
এসবের ক্ষোভে সর্বশেষ নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় মোল্লাদের আন্দোলনের নেপথ্যে বিএনপির ইন্ধন ছিল। গত নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে গোল্লা পাওয়া রেজা কিবরিয়ার স্বপ্ন আগামীতে কোন দিন বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তিনি অর্থমন্ত্রী হবেন।
এরজন্যে এখন নুরুদের দল করলেও তিনি সে দল নিয়ে অথবা একা বিএনপিতে মিশে যেতে একদম দেরি করবেননা। র্যাবের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বেজায় খুশি সাবেক স্ত্রী রীনা সুলতানা ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করা রেজা কিবরিয়া। সকালসন্ধ্যা নাটকের শাকেরা সেই রীনা সুলতানা।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে খুশিতে ডগমগ কিবরিয়া প্রতিদিন শেখ হাসিনা সরকারকে ফেলে দিচ্ছেন। এক পত্রিকাকে দেয়া ইন্টারভ্যুতে তিনি বলেছেন, এই সরকারের পিছনে ভারতের সমর্থন এখন কোন ব্যাপার না। ভারতকে তারা এ নিয়ে কোন অনুরোধও করবেননা।
এরমানে রেজা কিবরিয়া বুঝে গেছেন আগামীর কল্পলোকের সরকারের অর্থমন্ত্রী তিনি হয়েই গেছেন! খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১/১১’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। সেই খালেদা জিয়া আগামীতে আইনত এবং শারীরিকভাবে নির্বাচন করতে এবং প্রধানমন্ত্রী হতে অক্ষম।
সেই বিএনপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদের যুদ্ধাপরাধের অপরাধে ফাঁসিতে মৃত্যু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসিতে প্রান গেছে একাত্তরে বাংলাদেশের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর প্রধান সব নেতার।
বয়স হওয়ায় ব্যারিষ্টার মওদুদ, এম কে আনোয়ার সহ বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতার মৃত্যু হয়েছে। আরও অনেকে মৃত্যুপথযাত্রী। এই বিএনপির পারিবারিক প্রধান নেতা তারেক রহমান একাধিক মামলার দন্ড মাথায় নিয়ে দেশের আইনের চোখে পলাতক অবস্থায় বাস করছেন লন্ডনে।
এতিমখানা দুর্নীতি, গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক সাজাপ্রাপ্ত। ১/১১’র আর রাজনীতি না করার লিখিত বন্ড দিয়ে মেরুদন্ডের চিকিৎসার কথা বলে তারেক দেশ ছেড়েছিলেন। সেনা কর্মকর্তারা তার পা বেঁধে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন!
সাবেক সেনা প্রধান আর প্রধানমন্ত্রীর ছেলের হাওয়া ভবন দৌরাত্মে কি ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছিল! এরপর অনেক দিন সবাই শুনলো–জানলো তারেকের চিকিৎসা আর শেষ হচ্ছেনা! আদতে বিলাতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে তিনি সপরিবারে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট ত্যাগ করেছেন।
দেশের অহংকার সবুজ পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন ব্রিটিশ সরকারকে। তিনিই এখন বিলাতে বসে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশে কেউ আশ্রয় পেতেও সাবেক দেশের নাগরিকত্ব–পাসপোর্ট ত্যাগ করতে হয়।
সাধারনত এ ধরনের ঘটনা বিলাতের মতো একটি প্রাইভেসী সুরক্ষা আইন সচেতন দেশের সরকার গোপন রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারনে ব্রিটিশ সরকারের ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগে তা প্রকাশ পেয়ে যায়।
তারেক ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাখ্যাত বাংলাদেশি সব পাসপোর্ট লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বারবার অনুরোধেও দন্ডপ্রাপ্ত তারেককে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করেনি ব্রিটিশ সরকার।
দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী হওয়ায় তারেকের বক্তব্য দেশের মিডিয়ায় প্রকাশ ও প্রচার নিষিদ্ধ করেছে হাইকোর্ট। বিএনপি–জামায়াত সমর্থক মিডিয়ার এ নিয়ে হাত নিসপিস করে। কিন্তু আদালতকে তারাও ডরান। কিছু বলতে লিখতে পারেননা। দোষ দেন সরকারের।
বিশ্বের খ্যাতনামা রাজনীতিকরা এমন পরিস্থিতিতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দেশে এসে গ্রেফতারবরণ করেন। একটি দন্ডের বিরুদ্ধে আপিল করতেও আইনের কাছে আগে আত্মসমর্পন করতে হয়। কিন্তু তারেক রহমানের সেই রাজনৈতিক মেধা–যোগ্যতা পারেননি।
রাষ্ট্রপতি–প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসাবে তিনি আদরে বড় হয়েছেন। এরপর মামারা–ভাগ্নেরা মিলে কোকো লঞ্চ, ডান্ডি ডায়িং এর ব্যবসা করেছেন। এক পর্যায়ে বন্ধুত্ব পেয়েছেন গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের। বন্ধু বরাতে মোসাদ্দেক আলী ফালুর মতো মামুনও হয়ে ওঠেন দেশের অন্যতম ধনকুবের।
আবার সুযোগ পেলে গোপালগঞ্জেরও নাম বদলে দেবার শপথ ছিল খালেদা জিয়ার। বর্নবাদী চিন্তায় গোপালগঞ্জের লোকজনকে গালির সঙ্গে তিনি ডাকতেন গোপালি! সেই খালেদা জিয়া এখন গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ বিবেচনায় জেলখানার বাইরে বাসায় অবস্থান করছেন।
বিএনপি এখন সারাদিন এই করবো সেই করবো বললেও আদতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিত আবেদন করেই খালেদা জিয়ার বাসায় থাকার সুযোগের মেয়াদ বারবার বাড়ায়। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা, সন্তানের মৃত্যুসহ নানান রোগ–শোকের পাশাপাশি বার্ধক্যও বিএনপি নেত্রীকে কাবু করে ফেলেছে।
এরশাদ আমলে মিছিলের সঙ্গে হেঁটে সেনানিবাসের বাসা থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত আসতেন খালেদা জিয়া। আর একটা ৫০ সিসির মোটর সাইকেলে সেই মিছিলকে পাহারায় রাখতেন ফালু। সেই খালেদা এখন কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেননা। অস্ট্রিয়ো আর্থাইটিজ তাকে কাবু করে ফেলেছে।
এ রোগের সর্বোচ্চ চিকিৎসা হাঁটুর অস্ত্রোপচার তাঁর হয়ে গেছে দু’দফা। কারাগারের জীবনে জেদাজেদি করে তিনি সরকারি ডাক্তার দেখাতে রাজি হননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় ডাক্তাররা রাউন্ডে এসে তাঁর কেবিনের বাইরে অপেক্ষায় থাকতেন। কিন্তু তাঁর দেখা পেতেননা।
রোগ নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে জেদাজেদির ফল কখনও ভালো হয়না। সময়মতো চিকিৎসা, ফিজিও থ্যারাপি না নেয়ায় অস্ট্রিয়ো আর্থাইটিজে তাঁর দুই হাত বেঁকে গেছে। এখন তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দল চালান। স্থায়ী কমিটির বৈঠক করেন। কিন্তু গোয়েন্দারা সব তথ্য তাৎক্ষনিক জানতে পারেন।
কারন তারা বিএনপিতে সে অবস্থা করে ফেলতে পেরেছেন। হোয়াটসআপ নাম্বার অনুসরনের প্রযুক্তিও এখন কিনে ফেলেছেন বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। লন্ডনেও বাড়িভাড়া করে সর্বক্ষণিক টিম–নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতএব এই বিএনপি এখন তাদের কাছে মুখস্ত একটি দল।
সর্বশেষ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের এক সমাবেশে তারেক রহমান ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন। কেউ বাধা দেয়নি। নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেই বক্তৃতা মিডিয়ায়ও আসেনি। এটা উল্টো সন্দেহের জন্ম দিয়েছে! অতঃপর তারেক রহমানের নেতৃত্বেই কী চলছে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক মাইনাস পর্ব?
আগে প্রায় ‘খালেদা জিয়া জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন’, ‘তাঁর কিছু ঘটে গেলে সরকারকে দায় নিতে হবে’, এমন বক্তব্য রাখতেন বিএনপির নেতারা। কিডনি, হৃদরোগের পাশাপাশি তাঁর লিভার সিরোসিসের মতো জটিল ব্যাধির কথা বলা হতো প্রায়। কিন্তু বিএনপির নেতারা এসব আর এখন সিরিয়াসলি বলেননা।
এভাবে দিনে দিনে খালেদা জিয়া কী দলের সব হিসাব থেকেও মাইনাস হয়ে যাচ্ছেন? তাহলে বিএনপি দলটিও আরও বিবর্ন হবে। কারন তারেক রহমান তাঁর মা খালেদা জিয়ার মতো ক্যারিশমেটিক নন। খালেদা জিয়ার মতো ক্যারিশমেটিক বিএনপির কেউ নন।