ফজলুল বারী:নাশকতার আশংকার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব বাঁধা পেরিয়ে অতঃপর বহুল আলোচিত–প্রতীক্ষার স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করলেন তিনিই। বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা বলেছেন তাঁর মেয়ে। ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবেনা’!
পদ্মা সেতুর নির্মানকেও ‘দাবায়ে রাখা যায়নি’! শেখ হাসিনা নিজের হাতে উদ্বোধন করেছেন তাঁর কীর্তির। বিএনপি এখনও তসবিহ জপছে! ডিম আগে না মুরগি আগে! পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়কে দেখা গেলেও বঙ্গবন্ধুর আরেক মেয়ে শেখ রেহানার অনুপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিএনপি ঘোষনা দিয়ে জাতির এই আনন্দ বিজয়ের অনুষ্ঠানটি বর্জন করেছে। বিএনপি এভাবেই দেশের মূলধারা থেকে পিছিয়ে থাকে এবং পিছনে পড়ে যায়। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে মানুষের উচ্ছ্বাস বিএনপির নেতা–কর্মী–সমর্থকরাও এই পদ্মা সেতুর ওপর দিয়েই যাতায়াত করবেন।
গোপনে হয়তো ছবিও তুলবেন। বহিষ্কারের ভয়ে পোষ্ট করতে পারবেননা! এই দল আবার এখন বহিষ্কারের নতুন ভাষা–শব্দ বের করেছে, ‘চিরতরে বহিষ্কার’! আজব এবং অদ্ভূত এক সংকটে নিমজ্জিত এক দল এটি এখন তাইনা! দল চলে ভার্চুয়ালি! লন্ডন টু ঢাকা। দেশ যে কোথায় চলে যাচ্ছে তা বোঝার ঘিলু সবার থাকেনা ।
গত নির্বাচনে বিএনপি জোটের নেতা কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আ স ম আব্দুর রবগং বিএনপির লেজ ধরতে পিছিয়ে। বিএনপি জোটের বুদ্ধিজীবী ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে মিডিয়ায় বক্তব্য রেখেছেন।
তোষামোদকারীদের তোষামাদি স্বত্ত্বেও শেখ হাসিনা তাঁর নামে পদ্মা সেতুর নামকরন করতে রাজি না হওয়ায় ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞার প্রশংসা করেন। কাদের সিদ্দিকী, জাফরউল্লাহ চৌধুরী অনুষ্ঠান বর্জন না করায় এতে করে বিএনপি জোটের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতায় খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেছেন, দেখে যান পদ্মা সেতু হয়েছে কিনা। আওয়ামী লীগ আমলে পদ্মা সেতু হবেনা বলে খালেদা জিয়া যে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বক্তব্য দিয়েছিলেন, এটি সে জবাব। সাজাপ্রাপ্ত হওয়াতে খালেদা জিয়াকে অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয়নি।
যে সব শর্তে খালেদা জিয়া বাসায় আছেন, পদ্মা সেতু পর্যন্ত তিনি চাইলেও হয়তো যেতে পারবেননা। খালেদা জিয়া হয়তো মনে করেছিলেন এবং মিন করেছিলেন আওয়ামী লীগ এক মেয়াদে তথা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে এবং এই সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করতে পারবেনা।
আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদ ধরে ক্ষমতায় থাকায় খালেদা জিয়া এবং বিএনপি–জামায়াত জোটের স্বপ্ন–হিসাব নিকাশ ভেঙ্গে তছনছ–চুরমার। বড় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি–খালেদা জিয়া সাজা কার্যকর হয়ে গেছে। তারেক রহমান দন্ড মাথায় নিয়ে আইনের চোখে বিদেশে পলাতক। পদ্মা সেতুরও উদ্বোধন হয়ে গেলো।
গত কয়েক দিন বিএনপি নেতারা হাত–পা ছোঁড়ার ভঙ্গিতে বলছিলেন দশ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুতে তিরিশ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। আর বিএনপিপন্থী পত্রিকা প্রথম আলো হিসাব দিয়েছে ৩৫ বছরে পদ্মা সেতুতে ৯০ হাজার টাকা আয় হবে। পদ্মা সেতু নিয়ে গত কিছুদিন ধরে পত্রিকাটির উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মত ছিল।
দুর্নীতির কথিত অভিযোগ দেখিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গেলে যারা এ সেতুর ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন, সে দলে প্রথম আলো, ডেইলি স্টারও ছিল। নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করা সম্ভব নয় বলে যারা বক্তব্য দিয়েছিলেন তারা পত্রিকা দুটির ঘনিষ্ঠ এবং কলাম লেখক।
কেনো তারা এই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন সে বিষয়টি তারা পদ্মা সেতুর নির্মান শেষেও খোলাসা করেননি। আমার ধারনা এক ধরনের মাইন্ড সেটাপ থেকে তারা এমন বক্তব্য দিয়ে থাকতে পারেন। বাংলাদেশ এতদিন ছিল প্যারিস কনসোর্টিয়ামের সাহায্য নিয়ে বাজেট করা একটি দেশ!
প্রতিবছর বাজেটের আগে প্যারিসে দাতাদের একটি বৈঠক হতো। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সেই বৈঠকে গিয়ে নানান পরিকল্পনা–প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলতেন, টাকা দ্যান–এই করবো সেই করবো! এমন প্যারিস বৈঠকে যাবার সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা ছিল বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের।
সাহায্য কমে যেতে পারে এই আশংকায় সাইফুর রহমানকে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন করারও বিরোধী ছিলেন। এভাবে বাংলাদেশ ছিল দাতা দেশ–সংস্থাগুলোর আজ্ঞাবহ একটি দেশ। এমন একটি দেশের বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ অথবা তেমন সংস্থাও দাতা দেশ–সংস্থাগুলোর আজ্ঞাবহ।
তারা সে সব সংস্থায় কন্সাল্টিং করে আয় করেন অথবা তাদের অনুদানে প্রতিষ্ঠান চালান। নুন খান আর গুণ গান! খুব স্বাভাবিক একটি বিষয় আপনি যার টাকা নেবেন তার কথায় চলতে হবে অথবা তাদের প্রতি দূর্বল থাকতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দেশকে সেখান থেকে বের করে এনেছে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় শেখ হাসিনার একটি আওয়াজ আমার খুব কানে বেজেছে! ‘আমার মতো একজন অতি সাধারন মানুষ’! শেখ হাসিনা বলছিলেন, ‘মা–বাবা’র দোয়া সঙ্গে আছে বলেই আমার মতো একজন অতি সাধারন মানুষ দেশের জন্যে এভাবে কাজ করতে পারি’।
নিজের প্রতি এমন বিনয়ীরাই সারাক্ষণ কাজ করতে পারে। যারা নিজেদের সারাক্ষণ ‘হামসা বড়া কোন হ্যায়’ ভাবে তারাই এমন কাজ করতে পারেনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মনের দিক থেকে একজন বিশাল হৃদয়ের মাটির মানুষ ছিলেন। পিতার এই গুণ পেয়েছেন তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা।
আমি তাঁকে বলি একজন ফুল টাইমার প্রাইম মিনিস্টার এবং রাজনীতিবিদ। যিনি তাঁর ঘুমানোর সময় বাদে সারাক্ষণ কাজের মধ্যে থাকেন। কোন সাপ্তাহিক ছুটি বা অবকাশ তাঁর নেই। তিনি তাঁর কাজে ফাঁকি দেননা। তাই ফাঁকিবাজদের চটজলদি ধরে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
শেখ হাসিনার মতো একজন সর্বক্ষনিক নেত্রীর নেতৃত্বের কারনে পদ্মা সেতু সহ সব মেগা প্রজেক্টের কাজের এমন গতি। করোনা মহামারীর মাঝেও বাংলাদেশ পথ হারায়নি। গার্মেন্টস কারখানা সহ নানাকিছু আগেভাগে খুলে দেবার বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর দেশকে জানেন ভালো।
এরজন্যে দিনশেষে তাঁর সিদ্ধান্তগুলোই কার্যকর প্রমানীত হয়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে দেশেবিদেশে বাঙালি–বাংলাদেশি, বাংলাদেশের শুভানুধ্যায়ী ব্যক্ত–দেশের যে প্রতিক্রিয়া এসেছে তা প্রমান করেছে শেখ হাসিনার তুখোড় নেতৃত্বের দ্যুতি। ভয়াল বন্যার মাঝেও কোন কর্মসূচির হেরফের হয়নি।
বন্যা ত্রান চলছে–চলবে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন সহ সব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও চলেছে চলবে। জাতির নেতৃত্বে এমন দৃঢ়চেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও অভিনন্দন। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী সহ পদ্মা সেতুর নির্মানের সঙ্গে জড়িত সবস্তরের মানুষজনদের কৃতজ্ঞতা।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এমন একটি বিজয়ের দিনে বাংলাদেশের সব মানুষকে অভিনন্দন। এমন উচ্ছ্বাস কেউ আদেশ দিয়ে সৃষ্টি বা প্রতিহত করতে পারেনা। আমাদের সবার জন্মভূমি দেশটা শুধুই মর্যাদা–সমৃদ্ধিতে বড় হোক। জয় বাংলা।