একই অবস্থা ফরিদপুরগামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়ের! এ পথটির নির্মান শেষে অনেকে এর ছবিসহ ফেসবুকে পোষ্ট দিচ্ছিলেন আর লিখছিলেন এটা সিঙ্গাপুর নয় বাংলাদেশের ছবি।
কিন্তু এ পথে টোল যখন চালু হলো তখন নিউজ আসছিল টোল নেয়া কেন্দ্রিক ধীরগতির কারনে সৃষ্ট যানজট সংক্রান্ত!
উন্নত ডিজিটাল বিশ্বে এখন আর টোল প্লাজা বলে কিছু নেই। টোলের রাস্তায় ঢুকতেই মাথার ওপর যে আর্চওয়ে সেটাই টোল প্লাজা। সেখানে কোন মানুষ নেই। আর্চওয়েতে থাকা ক্যামেরা আপনার টোলট্যাগ থেকে ইলেক্ট্রনিকলি টোলের টাকা আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে কেটে নেবে।
আপনাকে যখন টোলট্যাগ দেয়া হয় তখনই নিয়ে রাখা হয় আপনার একাউন্ট ডিটেইলস। এরসঙ্গে ইলেক্ট্রনিকলি যুক্ত থাকে আপনার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার। বাংলাদেশের বিআরটিএ সব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ইলেক্ট্রনিকলি আপডেট না করা পর্যন্ত ডিজিটালি টোল নেয়া সম্ভব নয়।
বিদেশে টোলট্যাগ ছাড়াও টোল নেবার পদ্ধতি আছে। টোলের রাস্তায় দেয়া থাকে বিশেষ একটি নাম্বার। টোলের পথ ব্যবহারের তিনদিনের মধ্যে ফোনে বা অনলাইনে টোল দেয়া যায়। তিনদিনের মধ্যে টোল পরিশোধ না করলে দাপ্তরিক চার্জ টোলের চিঠি আসবে।
আবার একই গন্তব্যে যাবার জন্যে টোল ছাড়া পথও আছে। আপনাকে অপশন দেয়া হয়, টোলের রাস্তায় যেতে অত সময় টোল ছাড়া যেতে অত সময় লাগবে। এসবের কোনটার অবকাঠামো এখনও বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশে মানুষ এখনও টোল দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে!
জনগনের টাকার সেতু বা রাস্তায় টোল দিতে হবে কেনো! সব রাস্তা-সেতুই জনগনের টাকায় নির্মান করা হয়। জনগনের টাকায় সড়কের নির্মান ব্যয়, রক্ষনাবেক্ষনের খরচ টোলের মাধ্যমেই তোলা হয় সারাবিশ্বে। আরেক কথা বলা হবে আমার ট্যাক্সের টাকা! ১৭ কোটি মানুষের দেশে এক কোটি মানুষওতো ট্যাক্স দেননা।
বাংলাদেশে আবার ঈদ এসেছে। রেলস্টেশনে লম্বা লাইনসহ মানুষের ভোগান্তির নিউজ-ছবি আবার আসতে শুরু করেছে। কারন দেশটা যে এখনও ডিজিটাল হয়ে ওঠেনি। মন্ত্রী বলেন টিকেটের জন্যে ঘন্টায় অত লক্ষ মানুষ হিট করে অনলাইনে! অনলাইন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে!
এই মন্ত্রীরতো চাকরি থাকার কথা নয়। তার কথায় ডিজিটাল বাংলাদেশের বদনাম হয়। অথবা বলতে হয় দেশটার অনলাইন শক্তিমত্তা দূর্বল! ট্রেনে টিকেট মানুষ অনলাইনে কিনতে পারছেনা। অনলাইনে একজন টিকেট কিনলে তাকে কেনো আবার টিকেটের জন্যে স্টেশনে আসতে হবে? এখানেইতো দুর্নীতির গন্ধ!
সিডনির সাংবাদিক আবু তারিক অস্ট্রেলিয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে পথ শাসনের নানান খুঁটিনাটি তথ্য লিখেছেন ফেসবুকে। বাংলাদেশে সবকিছু অস্ট্রেলিয়ার মতো হতে হবে এটা কেউ বলছেনা। অস্ট্রেলিয়া সহ অন্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে।
অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের জনসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। গাড়ির সংখ্যা, রাস্তা এবং যথেষ্ট পরিমানে পুলিশ রাস্তায় না থাকার কারণে প্রতিটি রাজ্য সরকার পথ নিরাপত্তার বিভিন্ন পদক্ষেপ ডিজিটালি নিয়ে নিয়ে থাকে। শুধুমাত্র মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য নয়, সাথে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত মানুষের চিকিৎসা খরচও এখানে সরকারকেই বহন করতে হয়।
দেশটার জনগনও মনে করে সরকার যেনো নিহত-আহত মানুষের সংখ্যাটা কমায়। নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে গিয়ে আবু তারিক লিখেছেন, তিনি যখন ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন, তখন তিনি যখনই কারো গাড়িতে চড়তেন, তার প্রশ্ন থাকতো, এতো খালি রাস্তায় যেখানে কোনো পুলিশও নেই কেনো।
তাঁর মনে প্রশ্ন তৈরি হয় পুলিশই যেখানে নেই, সেখানে,তার চালক কেনো এত কম গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন! তাকে বহনকারী গাড়ির চালকের উত্তর ছিল, তুমি পুলিশ দেখবে না রাস্তায় যতক্ষণ তুমি নিয়ম মেনে গাড়ি চালাবে। নিয়ম ভঙ্গ করলে, হয়তো দু একবার পার পেয়েও যেতে পারো।
কিন্তু ধরা তোমাকে পড়তেই হবে। এখানে আইনভঙ্গকারীদের পাকড়াও করতে পথে পথে ছড়ানো আছে ডিজিটালি ক্যামেরার জাল! এরা দুটো করে ফ্লাশ মারবে। এরপর বাড়ির লেটারবক্সে চলে আসবে ফাইনের চিঠি। কারন এই নাম্বার প্লেটের গাড়ির মালিক কোন ঠিকানায় থাকেন, সবকিছু ডিজিটালি খুঁজে পাওয়া যায়।
অস্ট্রেলিয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো একটা গুরুতর অপরাধ। এরজন্যে ঠিক করা আছে মোটা অংকের ফাইন। এদেশের ডাইভিং লাইসেন্স নানা ক্যাটাগরির। গাড়ি চালানোর আইনকানুন অনলাইনে প্র্যাকটিস করে অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে অর্জন করতে হয় এল তথা লারনার লাইসেন্স।
লারনাল লাইসেন্সপ্রাপ্ত এল (L ) প্লেট লাগানো শিক্ষার্থী চালককে একজন ড্রাইভিং ইন্সটাক্টর বা পূর্ণ লাইসেন্সধারীকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। শিক্ষার্থী চালকের বয়স ২৫ র নীচে হলে বলতে গেলে প্রায় এক বছরের মতো সময়ের ভিতর এইভাবে নিয়ম মেনে ১৫০ ঘন্টা গাড়ি চালানোর পরে টেস্ট দিতে হয়।
টেস্টে পাস করলে তাকে দেয়া রেড পি তথা এক বছরের জন্য প্রভিশনাল লাইসেন্স। এই সময়ে তার ডিমেরিটস পয়েন্ট থাকে ৩টি। এ অবস্থায় একবার ক্যামেরায় স্পিডিং এর জন্যে ধরা পড়লেই প্রভিশনাল লাইসেন্সওয়ালার লাইসেন্স তিন মাসের জন্যে স্থগিত হয়ে যায়।
অর্থাৎ তিন মাস তিনি আর গাড়ি চালাতে পারবেননা। এক বছর পর অনলাইনে হেজার্ড টেস্ট দিয়ে পেতে হয় দুই বছরের জন্য গ্রীন পি লাইসেন্স। গ্রীন পি’ধারী চালক দু’বছর পর আবার অনলাইনে হেজার্ড টেস্ট দিয়ে ফুল লাইসেন্স পান। ফুল লাইসেন্সধারীর পয়েন্ট থাকে তেরটি।
এর একটি পয়েন্ট খোয়া গেলে সেটি তিন বছর চার মাস পর ফেরত আসে। অর্থাৎ একজন চালকের ১৩ টি পয়েন্ট খোয়া গেলে তিনি তিন বছর চার মাস গাড়ি চালাতে পারবেননা। এসব কড়াকড়ির কারনে লোকজন গাড়ি চালনায় অনেক সতর্ক থাকেন। কারন এখানে গাড়ি চালানো কাজের জন্যেও গুরুরত্বপূর্ণ।
গাড়িতে বসে একজন চালকের প্রথম কাজটাই হলো সিট বেল্ট বাঁধা। সিট বেল্ট না বাঁধলে কোনো কথা নাই। মোটা অংকের ফাইন এবং সাথে পয়েন্ট খোয়ানো। গতি সীমা থেকে ১০ কিমি উপরে কিন্তু ২০ কিমি নীচে আরেক ধরণের ফাইন যার পরিমান অনেকটাই দ্বিগুন।
এই সীমায় ধরা পড়লে রেড P লাইসেন্স হারায় এবং গ্রীন P কিছু পয়েন্ট অবশিষ্ট থাকে। আর গতিসীমার থেকে ২০ কিমি বেশি গতিতে গাড়ি চালালে, পূর্ণ লাইসেন্সও বাতিল সহ সাথে মোটা অংকের ফাইন এমনকি গাড়ি আটকে সরকারিভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংসও করে ফেলতে পারে, ক্ষেত্র বিশেষে জেলও হয়।
স্কুলের শুরুতে এবং শেষের দিকে স্কুলের আশেপাশে ৪০ কিমি গতি সীমা লংঘন করলে জরিমানার সঙ্গে পয়েন্ট হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। এছাড়াও লং উইকেন্ড, ইস্টার হলিডে, খ্রীস্টমাস হলিডেতে গাড়ির গতির উপর দ্বিগুন ফাইন। মদ খেয়ে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে বিশেষ আইন প্রয়োগ করা হয়।
L, রেড P, গ্রীন P ধারী চালক মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে পারবেন না। ধরা পড়লে লাইসেন্স শেষ। পূর্ণ লাইসেন্স ধারীরা খুবই অল্প পরিমানে মদ জাতীয় কিছু খেয়ে পার পেয়ে গেলেও সীমা ছাড়িয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে লাইসেন্স নিয়ে টান শুরু হয়, এমনকি জেলেও যেতে হতে পারে।
ফোন হাতে ধরে গাড়ি চালালে খোয়া যায় ৫ পয়েন্ট এবং মোটা অংকের জরিমানা গুনতে হয়। আর এইগুলো শনাক্ত করতে বিশেষ ক্যামেরা এদেশের রাস্তায় রাস্তায় বসানো আছে।
সুতরাং, গাড়ি চলানো অবস্থায় কেউ মোবাইল ফোন ধরবেন, তা হবে না।
স্পিডিং করবেন কিংবা ট্রাফিক লাইট অমান্য করবেন আর ভাববেন কেউ দেখেনি? তা কিন্তু নয়। রাস্তায় রাস্তায় ক্যামেরা আপনার গাড়ির নম্বর প্লেটের ছবি তুলে কোথায় কখন আপনার গাড়ি কতো গতিতে গিয়েছে সেটার ছবি সহ ফাইনের চিঠি পাঠিয়ে দিবে। ফাইন দেবার পরে লাইসেন্স থেকে কেটে নিবে পয়েন্ট।
আবু তারিকের প্রশ্ন, প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে বাংলাদেশে পদ্মা সেতু বানানো হলো, অথচ সেখানে স্পিড ক্যামেরা নেই! etag নেই! যদি এসব থাকতো তাহলে টোল প্লাজাতে এতো দীর্ঘ লাইন হতো না আর স্পিড ক্যামেরা থাকলে প্রথম দিনেই দু’ জন লোক অতিরিক্ত গতিতে মটরসাইকেল চালিয়ে প্রান হারাতো না।
এছাড়াও অন্য যারা গতি সীমা অতিক্রম করে গাড়ি চালিয়েছেন তাদের যে পরিমান ফাইন হতো তা, টোল আদায়ের চেয়ে ৫ গুন বেশী টাকা উপার্জন করতে পারতো দেশ। অস্ট্রেলিয়ায় বিলিয়ন ডলারের মালিক হউক আর প্রধানমন্ত্রী হউক, রাস্তায় নিয়ম ভেঙ্গে গাড়ি চালানো অবস্থায় ধরা পড়লে তাকে ফাইন দিতেই হয়। কেউ তা ঠেকাতে পারে না।
বাংলাদেশে বড়দের আইন মানতে হয়না। বিআরটিএ, পাসপোর্ট অফিস, বিমান বন্দর, ট্রেনের টিকেটসহ যে যেখানে দুর্নীতি করবে সে সেখানে এনালগ ব্যবস্থা সব করে রেখেছে। এসব নিয়ে লিখলে বলবে বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলান কেনো! এরপরই আবার বাংলাদেশও একদিন উন্নত রাষ্ট্র হবে বলে পোষ্ট দেবে! সবকিছুতে এমন স্ববিরোধিতা!