ফজলুল বারী: পদ্মা সেতুর কেন্দ্রিক সুখের স্ট্যাটাসগুলো পড়ে মন ছুঁয়ে যায়। সাংবাদিক প্রবীর শিকদার লিখেছেন, ‘ঢাকা মিরপুরের বাসা থেকে তাঁর ফরিদপুরের কানাইপুরের বাড়িতে ১১০ মিনিটে পৌঁছেছেন। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।‘ প্রবীর শিকদার একজন শহীদের সন্তান।
সেতুর প্রথম টোল ৭৫০ টাকা পরিশোধ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির বহরের সবক’টি গাড়ির ১৬ হাজার ৪০০ টাকা শেখ হাসিনা নিজেই পরিশোধ করেন। এ তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারনেই যে বাংলাদেশের অনেক প্রভাবশালীরা টোল পরিশোধ করতে চাননা।
আগামীতেও যেন এই ধারা বজায় থাকে। কোন মন্ত্রী–এমপি বা সরকারি–বেসরকারি কারো গাড়ির বহরের টোল নিয়ে যাতে মুলোমুলির খবর না আসে। টোলের হার নিয়ে শুরুতে অনেকে অসন্তোষ দেখালেই ফেরীঘাটের কষ্ট আর ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে টোলের টাকার অসন্তোষ ভুলে যাচ্ছেন।
সেতু ধরে যাতায়াতের প্রথম শুক্রবারে ৩ কোটি ১৬ লাখ টাকার টোল আদায় হয়েছে। শুক্রবার ছুটির দিনে বাংলাদেশের অনেকেই গ্রামের বাড়ি যান। এভাবে আগামী ছুটির দিনগুলোয় দেখবেন সেতুর আয় আরও বাড়বে। এতে করে ৩৫ বছরে নয়, আরও আগে সেতুর খরচ উঠে আসবে।
জিডিপির যে প্রবৃদ্ধির ধারনা দেয়া হয়েছে, প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতে পারে। বাঙালি সৃষ্টিশীল এক জাতি। শুধু তাদের একটু পরিবেশ দিতে হবে। বিদেশে একজন বাড়ি কেনেন ব্যাংক থেকে তিরিশ বছরের ঋন–কিস্তিতে। কিন্তু বেশিরভাগ বাংলাদেশি বেশি কাজ করে আগেভাগে ঋনের শোধ দিয়ে ফেলেন।
কর্নফুলি টানেল চালু হয়ে আনোয়ারা থেকে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে পৌঁছা যাবে ৩০ মিনিটের মধ্যে। কক্সবাজার সহ গোটা অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভ্রমন সময় কমে আসবে। কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস চালুর পর বিপ্লব ঘটে যাবে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। বাংলাদেশের আরও অনেক প্রবৃদ্ধি সামনে।
একটা ঘটনা বলি। ২০০৮–২০০৯ অর্থনৈতিক মন্দার সময় অস্ট্রেলিয়া সরকার নাগরিকদের ব্যাংক একাউন্টে দু’বার ৯৫০ ডলার করে প্রনোদনা জমা দেয়। রবিবার ফ্যামিলি ফান ডে নামের বিশেষ একটি টিকেট চালু করে। আড়াই ডলারের টিকেটে রবিবার সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ট্রেন–বাস–ফেরীতে আনলিমিটেট ভ্রমন করা যেত।
এই প্রনোদনা, ফ্যামিলি ফান ডে’র টিকেট চালুর কারন ছিল–মন্দার কারনে লোকজন যাতে ভয় না পেয়ে সপরিবারে ভ্রমনে বেরোয়। হাতে বাড়তি ডলার পরিবারগুলো শপিংমলে শপিংয়ে বেরুলে, টুরিস্ট স্পট সহ নানা জায়গায় ঘুরতে–খেতে বেরুলে বাজার চাঙ্গা থাকবে। মন্দার ভয় দূর হবে বাজারে।
পদ্মা সেতু সহ মেগা প্রকল্পগুলোর কারনে দেশের ভিতরে পরিবারগুলোর মুভমেন্ট বাড়বে। অভ্যন্তরীন ট্যুরিজম আরও বাড়বে। গ্রামের বাড়িতেও যদি তারা যায় তাহলে গ্রামের বাজারে চা–খেতে আড্ডা দিতে বেরুবে। গ্রামের বাজারগুলোর বিকিকিনিও বাড়বে। অতএব বাংলাদেশের সামনে এখন শুধুই সুদিন।
আগে কুরবানির ঈদের আগে সীমান্তে গরুর চেকপয়েন্ট বসানো হতো। এভাবে চোরাই গরুর অভ্যর্থনা করতো প্রশাসন! সেই গরুর হাটের চাঁদা দিতে হতো কতজনকে! এখন বাংলাদেশে কুরবানির ঈদে ভারত থেকে গরু আসেনা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মুরগির খামারের মতো গরুর খামার গড়ে উঠেছে।
খামারে মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন নতুন এক দৃষ্টান্ত। মৎস খামার মানে এখন শুধু মাছের ঘের নয়। তৈরি পোশাক কারখানাকে কেন্দ্র করে যেমন কাপড়–বুতাম সহ নানাকিছুর পাশাপাশি থ্রি–পিস, স্যান্ডেল–ফিতা–লিপিস্টিক সহ নানান শিল্প গড়ে উঠেছে।
এসব মাছের খামার–পশু–পাখির খামারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মাছ–পশু খাদ্য সহ নানান শিল্প। কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রতিনিয়ত কৃষি জমি কমছে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ দূর্বিপাকে ফসল হারিয়ে মাছের খামার–হাঁসের খামার ভেসে যাওয়াতে কৃষকদের ভিত্তি ভেঙ্গে পড়ছে বারবার।
দেশে এখন কৃষকদের শক্তিশালী কোন সংগঠনও আর নেই। লড়াকু কৃষক আবার দাঁড়াবার চেষ্টা করে নিজেদের উদ্যোগে। কৃষক এখন ধানের দাম যখন পায়না তখন ভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হয়। এরকারনে বাংলাদেশ এখন আর ধান–চাউল উৎপাদনে স্বয়ং–সম্পূর্ণ দেশ নয়।
বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম চাউল আমদানিকারক দেশ। আর বোকা মিডিয়া রিপোর্ট করে ধানের ভরা মওসুমে চাউলের দাম বাড়তি কেনো! যেন বোকা কৃষক কেনো তার ধান–চাউল কমদামে বেচে দিচ্ছেনা! ধান–চাউল সহ বেশিরভাগ কৃষিপন্যের উৎপাদনমূল্য–বিক্রয়মূল্য সম্পর্কে বেশিরভাগ রিপোর্টারের ধারনা নেই।
কারন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মিডিয়ার অবস্থা পোশাক–কারখানার চেয়ে খারাপ। এক রিপোর্টার দিয়ে সব রিপোর্ট করানো হয়। অথচ কৃষি রিপোর্ট আলাদা। পশু–পাখি বা মাছেরের খামারের রিপোর্ট আলাদা। বাংলাদেশে অনেক অপ্রচলিত কৃষিপণ্যের খামার গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে এমন যত রকমের খামার গড়ে ওঠে তত গড়ে ওঠে কর্মসংস্থানের সুযোগ। বাংলাদেশের এসব খামারিদের শুষে নেবার মানুষ বেশি। সহায়তাকারী কম। পদ্মা সেতু সহ নতুন সব যোগাযোগ অবকাঠামোর সুযোগ ফড়িয়ারা যতটা পাবেন, সাধারন কৃষক সেভাবে পাবেননা।
পড়াশুনা করা আধুনিক কৃষকেরা যারা অননাইন ব্যবসায় দক্ষ হয়ে উঠছেন, তারাই এর সুযোগটি নিজের করে নিতে পারবেন। এখন ইলিশ–পোয়া মাছ, আম–লিচু নানা কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বাজারজাত করতে শিখেছেন তারা সবাই প্রকৃত কৃষক নন।
তাদের অনেকেও নতুন রকমের ফড়িয়া। তাদের যারা সৎ তাদের মাধ্যমে কৃষক হয়তো একটু ভালো দাম পাচ্ছেন, অনেক কৃষক–ক্রেতার প্রতারিত হবার সুযোগও তৈরি হচ্ছে। তবে সবকিছুর ভালোমন্দের মতো শেষ পর্যন্ত ভালো টিকে থাকবে। দূর হবে মন্দ।
পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প জাতির নতুন স্বপ্ন দেখা আর সাহস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শুরু থেকে উদ্বোধন পর্যন্ত পদ্মা সেতুর সঙ্গে দুর্নীতির অপবাদ যুক্ত থেকে গেলো। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক এর অর্থায়ন থেকে সরে যাবার পর নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব নয় যারা বলছিলেন তারা শেষ দিন পর্যন্ত দুর্নীতির কথা বলেই গেছেন!
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি। বিএনপি সহ যত দল যত অভিযোগ করেছে এর কোনটাই সুনির্দিষ্ট নয়। দুর্নীতির অবকাঠামো বাংলাদেশে আছে। দুর্নীতি আগেও হয়েছে এখনও হচ্ছে, আগামীতে দেশ কবে দুর্নীতিমুক্ত হবে তা কেউ জানেনা। এরজন্য মানুষ এসব অভিযোগকে পাত্তা দেয় কম।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কাজের সংস্কৃতি। আপনি কাজ করেন। সৎভাবে কষ্ট করে সংসার চালান। কিন্তু আপনাকে যে দুর্নীতি বা সততার গল্প শোনায়, সে কী কাজ করে বা তার সংসার চালানোর উৎস আপনি জানেননা। ওই লোকটি যে তার আয়–রোজগার আপনার কাছে গোপন রাখে এটাও কিন্তু দুর্নীতি।
সবার কাজের–আয়ের বৃত্তান্ত পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের দুর্নীতি দূর হবেনা। সেটা তিনি রাজনীতিবিদ বা ধর্মীয় হুজুর–পুরোহিদ–পাদ্রী–ভিক্ষু যেই হোননা কেনো। পদ্মা সেতুর নির্মান ধারাবাহিকতায় কোথায় কত খরচ হয়েছে তা নিয়ে সরকার একটি রাজনৈতিক বক্তৃার হিসাব দিয়েছে।
এ নিয়ে বিস্তারিত ওয়েবসাইটে দিলে তাতে সরকারের স্বচ্ছতা বাড়বে। পাশাপাশি দুর্নীতির হিসাব যারা চাইবেন তাদেরও জনগনের সামনে স্বচ্ছতা দরকার। মির্জা ফখরুল বা রিজভি বা জোনয়েদ সাকি কী চাকরি বা ব্যবসা করেন, বাড়িভাড়া–সংসার কিভাবে চলে তা প্রকাশ করলে তাদেরও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ ভাবতে শিখবে এরা খারাপ আপনারা ভালো।