ফজলুল বারী:উত্তরবঙ্গের রেলওয়ের একটি শাখায় অমুসলিম স্টাফের অভাবে ঈদের দিন সার্ভিস বন্ধ রাখা নিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপন ইনবক্সে দিয়েছেন একজন। সঙ্গে মন্তব্য, দেখেন অবস্থা। আমি এটা দেখার চেষ্টা করিনি। কারন এরা সম্ভবত কাজের দুনিয়ার খবর কম রাখেন।
অস্ট্রেলিয়ায় আমি যে ছোট কোম্পানিতে কাজ করি সেখানে আমার রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে প্রায় সমস্যা হয়। ঈদের দিন ছেলেটাকে নিয়ে ঈদের নামাজে যেতে হবে। যেতে হবে বড় ছেলের কবরের কাছে। ঈদের দিন পরিবারের এইটুকুই চাহিদা। আমরা কত মানুষের কত কাজ নিয়ে ভাবি। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব নিয়ে সব সময় ভাবিনা।
আমার এক অমুসলিম সহকর্মী রবিবার চার্চে যান বলে রবিবার সাধারনত কাজ করেননা। তাকে বলেকয়ে আমার ঈদের দিন কয়েক ঘন্টার জন্যে রিপ্লেসমেন্ট হতে রাজি করিয়েছি। আমার অনুরোধে রবিবার সকালে তিনি আসবেন। দুপুর দুটোয় আমি আমার ফিরে আসবো।
এখানে তিনি দেখেছেন তার রবিবার প্রতি সপ্তাহে একবার আসে। আর আমার ঈদ প্রতি সপ্তাহে আসেনা। যেখানে যে সমাজে কাজের দুনিয়া যত একোমডেটিভ হয় সে সমাজ তত সহিষ্ণু-উন্নত হয়।
এর আগে আমার এক খ্রিস্টান নিয়োগকর্তা ঈদ এলেই কাতর কন্ঠে বলতেন তার কর্মীদের প্রায় শতভাগ মুসলিম। কাজেই আমরা যদি ঈদের দিন সবাই না আসি, ছুটি চাই তাহলে তাকে কোম্পানি গুটিয়ে চলে যেতে হবে। আমাদের যেহেতু কাজ দরকার, সপ্তাহ শেষে অনেকগুলো ডলার দরকার, তাই আমরা সেই নিয়োগ কর্তাকে এমনভাবে সার্ভিস দিতাম যাতে তার কোম্পানি গুটিয়ে যেতে না হয়।
এটিই হচ্ছে কাজের দুনিয়া। আমাদের এসব মিলমিশ কাজের কোন লিখিত প্রজ্ঞাপন অথবা ধর্মীয় সুড়সুড়ির প্রবনতা নেই। ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিতে বাংলাদেশে শুধু মৌলবাদী মুসলমান হওয়া লাগেনা। মূল প্রয়োজনটি হলো একোমডেটিভ হওয়া। এটাই কাজের দুনিয়ার দাবি।
ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে পাবলিক করা সেই প্রজ্ঞাপন দেখে কেউ এগিয়ে এসে বলেননি যে আমরা কাজ করবো। ঈদ উদযাপন হোক। সার্ভিসও চলুক। বাংলাদেশে অনেক সমস্যার সঙ্গে ধর্মীয় সুড়সুড়ি বড় একটা সমস্যা। সমাজের যে ভিতর থেকে বড় একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে। এ এক ভিন্ন অসহিষ্ণু সমাজ!
এর কুফল পাচ্ছে দেশ। পরিবর্তনটা নৈতিক নয়। অর্থনৈতিক। যে দেশ-সমাজ যত বেশি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকে সেখানে এর সংকটটা বেশি। কারন দুর্নীতিবাজরা ধর্মীয় প্রশ্নে দূর্বলও থাকে। বাইরে ফিটফাট হলে তার ভেতরের মানুষটি জানে সে দুর্নীতিবাজ। সিংহভাগ মোল্লা-পুরোহিতও দুর্নীতিবাজ। অথবা দুর্নীতিবাজদের পোষ্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন হয় তখন একদল শিক্ষিত ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতিক ভারতীয় সমাজ-রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলেন। সেই ভারতও বদলে গেছে। একদল হিন্দু মৌলবাদী সেখানে শুধু ক্ষমতায় নয়, তারা জনপ্রিয়ও। বাংলাদেশের সামরিক শাসকরা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কাজেই মৌলবাদী নেতৃত্বের বিশাল এক দেশের পাশে থাকা বাংলদেশ-সমাজকে আগের মতো ধর্ম নিরপেক্ষ আশা করাটা বৃথা। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, ভারতে যাই ঘটুক বাংলাদেশে কেন ঘটবে। এখানেই তারা ভুল করেন। এটিই বিশ্বায়ন। আলো-বাতাস গায়ে লাগবেই।
ভারতে যেতে পাসপোর্টে কি এন্ড্রোস করেন? ডলার না টাকা? ডলারের বান্ডিল পকেটে নিয়ে টাকায় আচরন দেখাতে নেই। ফেসবুকে একদল প্রায় কান্নাকাটি করেন আওয়ামী লীগ কেনো এমন হবে? এমন করবে? ২০০৮ এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পেয়ে আওয়ামী লীগ কি ১৯৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে পেরেছে?
বিসমিল্লাহ-রাষ্ট্র ধর্ম বাতিল করতে পেরেছে? পারেনি। কারন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিক্ত পরিস্থিতি শেখ হাসিনা জানেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রেডিও টেলিভিশনের এমনভাবে দোয়া-দুরুদ-হামদ-নাত চলতে থাকে যেন এক সঙ্গে এত মানুষ খুন করার কারনে ইসলাম রক্ষা পেয়েছে!
অনেকে বলার চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগ সেদিন রাস্তায় নামেনি! কে নেমেছে? হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মুসলমান কে নেমেছে রাস্তায়? দেশটা কি শুধু আওয়ামী লীগের? বিচার বিভাগ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর হাইকোর্টের ব্রাঞ্চ বিভাগীয় শহরগুলোতে নেয়া বাতিল করেছিল।
কিন্তু রাষ্ট্র ধর্ম বাতিল করেনি। বিচারপতি আর সিনিয়র আইনজীবীদের মফস্বলে যাতায়াতে কষ্ট যাতে না হয় এরজন্যে তারা হাইকোটের বেঞ্চ মফস্বলে নয় এতটুক শুধু বাতিল করেছেন। অথচ তখন রাষ্ট্র ধর্ম বাতিল করলে মোল্লারা হাইকোর্ট ভবন ভেঙ্গে ফেলতে চলে যেতোনা।
তাদের দৌড় বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত। কাজেই সব দোষ শুধু আওয়ামী লীগকে দিতে হবে কেনো? মোল্লারা আগুন জ্বালাতে নামে তখন কে তাদের রুখে দাঁড়াতে নামে? আওয়ামী লীগ নামেনা আপনি নামেননা কেনো? একুশ বছর আওয়ামী লীগকে রাস্তায় রেখে বাকিরা কী করছিলেন?
শুধু বঙ্গবন্ধুর মেয়ে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার ছবিগুলো দেখেছেন? শাড়ি পরা নিটোল এক বাঙালি রমনীর। মাথায় কাপড় বা ঘোমটা না থাকলেও রূচি স্নিগ্ধ। এখনকার শেখ হাসিনার মাথায় কাপড় ছাড়া কোন ছবি নেই। তিনি ধার্মিক। একজন একনিষ্ঠ প্র্যাকটিসিং মুসলিম। দেশটাকে তিনি চেনেন জানেন ভালো।
উন্নত বিশ্ব সহনশীল। পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। উস্কানির নয়। নুপুর শর্মা কি বলেছেন সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে সময় লেগেছে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিবাদ হয়ে যাবার পর আমরা টের পাই অবমাননা হয়েছে। সেখানে দোকান থেকে ভারতীয় পণ্য নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। সেই পণ্যও আবার দোকানে উঠে গেছে। বিক্রি হচ্ছে। কারন ওইসব পণ্যের উৎপাদন-সরবরাহ ভারত থেকেই হয়।
যত ভারতীয় মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কাজ করেন তাদের বের করে দিলে লালবাতি জ্বলবে মধ্যপ্রাচ্যের। কাজেই প্রতিবাদ যা করার তা করে ফেলে মধ্যপ্রাচ্য দরজা বন্ধ করে বসে থাকেনি। সেখানে মিছিল করা যায়না। আমাদের অনেকে মিছিল করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন।
ধর্মীয় বিতর্কে আমি সহজে জড়াইনা। আশেপাশের লোকজনকে জড়াতে নিষেধ করি। কারন সবকিছুর পরম্পরা আমরা জানিনা। ধর্ম নিয়ে যাদের বিস্তর পড়াশুনা তারা কল্লা চাইতে নামেনা। পৃথিবীর কোন ধর্ম অপর ধর্মকে মহান করতে আসেনি। ধংস করতে এসেছে।
যে চার-পাঁচটি প্রধান ধর্ম পৃথিবীতে শত শত বছর ধরে টিকে আছে একেবারে ফাও ফাও টিকে থাকেনা সবকিছু। কতকিছু পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। ধর্ম একটি বিশ্বাস। এটি যুক্তি মানেনা। যুক্তি দিকে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা নিরর্থক। যার ধর্ম থাকুক তার কাছে।
নুপুর শর্মা নিয়ে প্রতিবাদের মিছিলের বেশিরভাগ লোক জানতোনা তিনি কী বলেছেন। যারা জেনেছে এরপর অমুকের এই বয়স অমুকের ওই বয়সের টালি করতে গিয়ে কারোরই ইজ্জত থাকছিলোনা। পৃথিবী এক সময় সেখানে ছিল। এখনকার পৃথিবীতে সেখানে বসানোর চেষ্টা করাটা বোকামি।
নড়াইলে যে ছাত্রের নুপুর শর্মা বিষয়ক পোষ্ট নিয়ে এত গোলমাল এমন অনেকেই দেন। সেই ছেলেটি যে ইচ্ছা করেই একটি কান্ড ঘটানোর নিয়তে তা করেছিল সেটাও নয়। হালকা মেজাজের একটি পোষ্টকে গুড় লাগানো হয়েছে। এরপর গুজব ছড়িয়ে একজন হিন্দু শিক্ষককে পরানো হয়েছে জুতার মালা!
এখন প্রতিবাদের মুখে রাষ্ট্র সেই শিক্ষকের পাশে দাঁড়ালেও সেই ছাত্রটিতো কালপ্রিট থেকে গেলো! এর দায় তাকে ও তার পরিবারকে অনেকদিন বয়ে বেড়াতে হবে। পরিবারটির কত রকম অর্থনৈতিক সংকট যে চলতে থাকবে কেউ সে খোঁজ নেবেনা। কাজেই এমন কিছু নিয়ে সাবধান।
আমাদের কারো কোন কাজ যাতে কারও ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত বা সুড়সুড়ির পর্যায়ে না যায়। বা আমরা যাতে কারও হাতে কোন কার্ড তুলে না দেই। আমাদের অনেক কাজ আছে। নিজের-পরিবার ও সমাজের প্রতি আমাদের অনেক দায় আছে। এমন উৎকট অবস্থায় পড়লে আমাদের সব তছনছ হয়ে যায়।