ঈদের দিন

ঈদের দিন

খুব ভোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে বাহারের ঘুম ভাঙ্গলো। সে তাড়াহুড়া করে দরজা খুলতে গিয়ে দরজা খুঁজে পাচ্ছিল না। আজ ঈদের সকাল। এত সকালে কে কড়া নাড়বে? দরজা খুলতেই সে একটা অল্প বয়সী মেয়েকে দাঁড়ানো দেখতে পেল। সে গত তিনমাস আগে এই মেসে উঠেছে। আগে কখনো বাড়িওয়ালা বা আশেপাশের ফ্লাটের কারো সাথেই তার পরিচয় হয়নি। মেয়েটা বুঝতে পেরে সাথে সাথে বললো
এটা আমাদের বাসা। আজ মধ্যরাত থেকে হঠাৎ করে বাবার বুকের ব্যথাটা আবার বেড়েছে। এখনি তাকে ক্লিনিকে নিতে না পারলে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। আপনি কি কষ্ট করে একটা স্কুটার ডেকে আনতে পারবেন?
বাহার বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠে বললো
আমি এখুনি স্কুটার নিয়ে আসছি। সৌভাগ্যবশত দৌড়ে গেটের বাইরে যেতে না যেতেই একটা খালি স্কুটার পেয়ে গেলো। তারপর দোতালায় উঠে গিয়ে বাড়িওয়ালাকে ধরে ধরে স্কুটারে উঠতে সাহায্য করলো।
একে তো ভোর বেলা তার উপর ঈদের দিন। ঢাকার রাস্তা ঘাট একদম ফাঁকা। স্কুটার প্রায় হাওয়ার বেগে ক্লিনিকে পৌঁছল। ক্লিনিকও ফাঁকা ফাঁকা। ভাগ্য ভাল ইমারজেন্সিতে ডাক্তার পাওয়া গেলো। সাথে সাথে রোগীকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিয়ে যাওয়া হোল। বাহার এবং বাড়িওয়ালার মেয়ে দুজনেই পাশের একটা বেঞ্চে বসে পড়লো।
বাহারের গ্রামের বাড়িতে নিকটজন কেউ থাকে না। বাবা মা গত হয়েছে হাই স্কুলে থাকতে। বড় দুই ভাইবোন বিয়ের পরে যার যার সংসার সামলাতে ব্যস্ত। তারা দুজনেই ঢাকার বাইরে থাকে। তাই ঈদে বাহারের যাওয়ার কোন জায়গা নেই। মেসের অন্য দুজন গত পরশু বাড়ি চলে গেছে। গত ছয় মাস ধরে তার চাকুরীটাও নেই। টিউশনির টাকায় কোন রকম চলে যাচ্ছে।
একজন নার্স আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এসে বললো
রুগী এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। কিছু ঔষধ বাইরে থেকে আনাতে হবে। এই বলে একটা প্রেসক্রিপশন বাহারের হাতে ধরিয়ে দিলো।
মেয়েটা তার হাতব্যাগ থেকে দুটি পাঁচশ’ টাকার নোট বাহারের হাতে দিয়ে বললো আপনি একটা রিকশা নিয়ে চলে যান। আর কি মনে করে একটা ছোট্ট কাগজে তার মোবাইল নম্বরটাও লিখে দিলো।
বাহার রিকশা নিয়ে আশেপাশের ফার্মেসীগুলোতে ঔষধ না পেয়ে গ্রীন রোডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আর তা মেয়েটাকে জানানোর জন্য কাগজের টুকরো থেকে নম্বর দেখে তাকে ফোন করলো
আমি বাহার বলছি। আশেপাশের দোকান গুলোতে ঔষধ না পেয়ে আমি গ্রীন রোডের দিকে যাচ্ছি।
ওপাশ থেকে উত্তর আসলো
আমরা আপনাকে কঠিন বিপদে ফেলে দিয়েছি। সেজন্য দুঃখিত। আর তাড়াহুড়ার কারণে আমার নামটাও আপনাকে বলা হয়নি। আমি স্বর্ণা। একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।
বাহার ঔষধ নিয়ে দুপুরের কিছু পরে ফিরে আসে। রোগীকে তা খাওয়ানোর পরে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু বিপদ তখন কাটেনি বলে ডাক্তাররা জানিয়ে দেয়।
স্বর্ণাদের প্রায় সব আত্মীয় স্বজনেরা ঢাকার বাইরে ঈদ করতে চলে গেছে। তারা খবর পেয়েই স্বর্ণাকে ফোন করে খোজ খবর করতে থাকে। এদিকে স্বর্ণার মাও ব্যাকুল হয়ে বাসায় অপেক্ষা করছে আর বারবার ক্লিনিকে আসার জন্য তাকে ফোন করছে।
বাহার কিংবা স্বর্ণার সকাল থেকে কোন দানা পানি পেটে পড়েনি। তার উপর আজ ঈদের দিন। এদিকে বাহারের খিদের চোটে পেটে মোচড় দেয়া শুরু হয়েছে কিন্তু বেচারা লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। ঠিক তখনি স্বর্ণা বলে উঠলো
আপনার তো সেই সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি।
বাহার বিনয়ের ভঙ্গিতে বললো
কিছু হবে না। আর আপনিও তো না খেয়েই আছেন।
আপনি কি আর একটু কষ্ট করে বাইরে গিয়ে দেখবেন কোন খাবার পাওয়া যায় কিনা?
বাহার ক্লিনিকের আশেপাশে কোন দোকান খোলা পেল না। ঈদের দিনে কে দোকান খোলা রেখে বসে থাকবে। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর ফুটপাথের দোকান থেকে রুটি আর ভাজি কিনে সে ক্লিনিকে ফিরলো।
স্বর্ণার হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিতেই সে বললো
বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে আসেন। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
বাহার হাত মুখ ধুইয়ে এসে দেখে স্বর্ণা খবরের কাগজ বিছিয়ে তার উপর রুটি ভাজি সাজিয়ে অপেক্ষা করছে। তাকে দেখে কি মনে করে যেন ওড়নাটা টেনে মাথায় দিয়ে বললো
নেন শুরু করেন। তারপর একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে রুটি ভাজি সহ কাগজটা তার দিকে এগিয়ে দিলো।
বাহার বললো
কই আপনার জন্য তো রাখেন নি। কথাটা বলে নিজেই খানিকটা সংকুচিত হয়ে পড়লো।
না না এই যে আমার জন্যও রুটি ভাজি রেখেছি। বলে তার জন্য এক পাশে রাখা রুটি আর ভাজি দেখালো।
খেতে খেতে স্বর্ণা বললো
আজ ঈদের দিন। আমাদের সাথে এসে আপনার এবারের ঈদটাই মাটি হোল।
আসলে আমার ঢাকায় বা গ্রামে নিকট আত্মীয় বলে কেউ নেই। তাই আজ ঈদের দিনে বিশেষ কোথাও যাওয়ারও ইচ্ছে ছিল না। বরং ভালই হোল চাচাজির সাথে থাকতে পারলাম। কথাটা বলেই বাহারের বুক থেকে একটা দীর্ঘ-শ্বাস বেরিয়ে এসে চোখ দুটোকে একটু ভিজিয়ে দিয়ে গেল। স্বর্ণা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বললো
তারপরও তো বাবার ওষুধের জন্য আপনাকে অনেক ছোটাছুটি করতে হোল। না খেয়ে বিকাল পর্যন্ত থাকতে হোল। বাহার এর উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারলো না।
কিছুক্ষণ পরে বাহার গিয়ে বাসা থেকে স্বর্ণার মাকে ক্লিনিকে নিয়ে এলো। ডাক্তাররা জানিয়ে দিলো রাতটা পার না হওয়া পর্যন্ত রোগী সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। তাই সিদ্ধান্ত হোল বাহার আর স্বর্ণা বাসায় ফিরে যাবে। স্বর্ণার মা ওর বাবার সাথে রাতে ক্লিনিকে থাকবে।
স্বর্ণাকে নিয়ে বাহার সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরে এলো। বাহার রুমে ফিরে ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে হঠাৎ আবারও দরজার কড়া নাড়ার শব্দে বাহার উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
স্বর্ণাকে দেখে সে বেশ কিছুটা অবাক হোল। কিছুক্ষণ আগে গোসল করে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পরেছে। ভেজা চুল থেকে শ্যাম্পুর মিষ্টি গন্ধে চারিপাশটা সুভাষিত হয়ে উঠেছে। মাথা তুলে চোখে চোখ রেখে চিরচেনা আবদারের সুরে বললো
আজ ঈদের দিন। একটু আগে আমি রান্না শেষ করেছি। আপনি তৈরি হয়ে আসুন। আমি বাসায় খাবার টেবিলে আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে মিষ্টি হেসে ঘুরে দাড়িয়ে শ্যাম্পুর মিহি সুবাস আরও খানিকটা ছড়িয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো। বাহার হতভম্বের মতো সিঁড়ির ধাপগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে ভাবলো ভালবাসার আহ্বান অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়নি।
নাইম আবদুল্লাহ( লেখক ও সাংবাদিক )