পঁচিশ তিরিশ বছর আগে যখন বই মেলায় যেতাম, চারুকলার কাছাকাছি আসতেই কান ছুঁয়ে যেত নির্মলেন্দু গুন্, শামসুর রাহমান কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতা আবৃত্তি। আবৃত্তিকারদের কথা খুব একটা মনে নেই এখন। এখনও স্মৃতির দরজায় কান পাতলে শুনতে পাই ” কষ্ট নেবে ? কষ্ট? , নীল কষ্ট ………..” কার কবিতা মনে নেই, কিন্তু আবৃত্তিকারের কন্ঠতুলির ছোঁয়ায় কবিতাটি এখনও নরম রঙের ছবি হয়ে মনের ক্যানভাসে ছবি হয়ে আছে। আবৃত্তি একটা চমৎকার শিল্প মাধ্যম । কবিতার আবেগী -নিরাবেগী, প্রেমময়-বিদ্রোহী সকল শব্দ সমাহার আবৃত্তিকারের কন্ঠাভিনয়ের কল্যানে এক ধরণের ব্যাক্তিত্ব পায়। কবিতা তখন প্রাণ পায়। শ্রোতার কর্ণপথে প্রবেশ করে মনের রাজ্য দখল করে নেয়।
অনেকদিন বাদে সরাসরি আবৃত্তি শুনলাম। সম্মোহিত হয়ে টানা প্রায় ঘন্ঠা খানেক সৈয়দ শামসুল হক , শামসুর রাহমান, নাজিম হিকমত , কাজী নজরুল ইসলাম সহ আরও অন্যান্য কবিদের কবিতার আবৃত্তি। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম আবৃত্তিকার আহকামউল্লাহ এবং মাহিদুল ইসলাম মাহীর আবৃত্তি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝকমকে দিনগুলোতে কার্জন হল, টি এস সি কিংবা মধুর ক্যান্টিনের আশেপাশে ঘাসের আসনে বসে কতদিন আমরা ক্ষুধা – তৃষ্ণা ভুলে যাওয়া ঝাঁকেঝাঁকে চলা তরুণ তরুণীরা নব্বইয়ের আন্দোলনের সময় আহকাম ভাই , মাহী ভাইদের কণ্ঠ যাদুতে সম্মোহিত হয়েছি।
পঁচিশ তিরিশ বছরের সময়-দৈর্ঘ্য আহকাম ভাইয়ের কন্ঠের গুরুগম্ভির গভীরতাকে একটুও মলিন করেনি। বরং আরও বেশী আবেগের গহনা পড়িয়েছে। দেখে অবাক হলাম এখনও বাক্যের পর বাক্য – অসংখ্য বাক্য খাতা বইয়ের দিকে না তাকিয়ে ছন্দের দোলে কন্ধ দুলিয়ে আবৃত্তি করতে করতে কবিতার শব্দরাজ্যে অনায়াসে অভিবাসী উঠছেন দুজনেই। এক নাগাড়ে পড়ে গেলেন সুদীর্ঘ সব কবিতা। কখনও একক কখনও দৈত্ব কন্ঠে। একজন পড়ছেন তো আরেকজন হামিং করছেন – মাঝে মাঝে কোরাস করছেন। পরস্পরের প্রতি সমঝোতা না থাকলে এরকম করে উপস্থাপন করা যায় না।
আহ্কাম ভাইয়ের কন্ঠ-গভীরতা চমৎকার। গমগম করে বেজে উঠা সরোদ কিংবা ভিওলার মতন। অন্যদিকে মাহী ভাইয়ের কণ্ঠ বৈচিত্র্য অনেকটা সেতারের মতন কন্ঠ-প্রস্থ অনেক চওড়া। একারণে মাহি ভাইয়ের আবৃত্তিতে আবেগের বৈচিত্র্যও চোখে পড়ে বেশী।
অবশেষে মাহীভাই আমাদের সুগায়ক বন্ধু এহসানের সাথে যুগলবন্ধী করলেন গান ও কবিতার যুগলবন্ধী।এহসান গিটার বাজিয়ে গাইলো ‘আমি বাংলায় গান গাই’আর মাহী ভাই হৃদ কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন গানের বাক্যগুলো।
প্রবাসে এহেন চমৎকার পরিবেশনা দুর্লভ। আমার তেরো বছরের অস্ট্রেলিয়া জীবনের সবচেয়ে বাংলাকাতর ক্ষণ কাটিয়েছি এই যুগলবন্ধী শোনার সময়।
এই চমৎকার আয়োজনটির জন্য আয়োজকদের সকলকে ধন্যবাদ এবং তাদের মধ্যে আমার পরিচিত
অতি প্রিয় কয়েকজন মুখের মধ্যে তারিক ভাই ও সেলিমা আপাকে স্বকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
যারা প্রতিবছর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস ,
পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস পালনকরছেন ,আর আমরা স্ব পরিবারে দেশজ সংস্কৃতির স্বাদ উপভোগ করছি।
(ইমতিয়াজ কায়েছ রিশা , সিডনি থেকে )