আমরা যারা প্রবাসী অর্থাৎ বাংলাদেশ ছেড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকি, আমাদের প্রত্যহ জীবনে বাংলাদেশের জীবনযাপন ভীষণভাবে অনুভব করি। এই ফেলে আসা দেশকে প্রবাসে ফিরে পাওয়ার তাড়নায় আমাদের প্রবাস জীবনে আমরা নানারকম কর্মকান্ডে নিজেদের ব্যস্ত রাখি। অস্ট্রেলিয়াতে আমাদের এই ব্যস্ততার মাঝে সবচাইতে বেশী যে আয়োজনটা দেখা যায় সেটা হচ্ছে দাওয়াত। বিয়ে, গায়েহলুদ, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, বেবি-শাওয়ার, বাচ্চার আকিকা, বাচ্চার মুখে ভাত, বাচ্চার মুসলমানি এসব ছাড়াও পুনর্মিলনী, ফিরানী খাওয়া, ঈদ, পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন প্রভৃতি অনুষ্ঠানে আমাদের সাধ্যমতো দাওয়াত এর আয়োজন থাকে। এসব দাওয়াত এ আবার মাঝে মাঝে স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে গান পরিবেশন করানো হয়। স্থানীয় শিল্পীরা আবার সব দাওয়াত এ গান পরিবেশন করেননা। শুধুমাত্র আয়োজকের পকেট এবং সামাজিক অবস্থান ভারী হলেই স্থানীয় শিল্পীদের পাওয়া যায়।দাওয়াত বাদ দিয়ে আর একধরণের বাঙালিয়ানা আয়োজন, বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রায়শ চোখে পড়ে।
সংগীতের ভিত্তি হচ্ছে তাল (রিদম) এবং লয় (বীট)। তাল হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর চক্রাকারে একই ঘটনা বার বার ঘটা। যেমন ২৪ ঘন্টা পরপর পূর্বদিকে সূর্যোদয় অথবা আমাদের হৃদস্পন্দন। আর লয় হচ্ছে দুটি তালের মধ্যবর্তী নির্দিষ্ট সময়, যেমন দুটি সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময় ২৪ ঘন্টা অথবা দুটি হৃদস্পন্দনের সময়ের পার্থক্য। প্রাকৃতিক বিবর্তনের শুরুর দিকে মানুষের মাঝে এই তাল অনুভূতি বিকাশ হয়। ধারণা করা হয় প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য একসাথে বা দলবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য এই তাল এর সৃষ্টি। গবেষকদের মতে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর শ্রবণকেন্দ্রিক এই ক্ষমতা নেই। এখনো আমরা দেখি যখন অনেক শ্রমিক একসাথে যখন কোনো কাজ করে তখন “আরো জোরে হেঁইয়ো” বলে তাল বা rythm সৃষ্টি করে যাতে করে সবাই একসাথে বল প্রয়োগ করতে পারে। এই তাল থেকেই ধীরে ধীরে সংগীতের শুরু। ইতিহাস থেকে জানা যায় সম্ভবত ৩৪০০ বছর আগে উগারিট (সিরিয়ার কাছে) থেকে প্রাচীন গান এর শুরু (মতভেদ থাকতে পারে) যা কালের পরিক্রমায় আজকের আধুনিক গান।
সংগীতের শুরু যদিও মানুষের একতার জন্য, মানুষের প্রগতির জন্য, কিন্তু এই সংগীত ক্যানবেরা সহ অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে হয়ে গেছে মানুষের বিভক্তির একটি কারণ। দেশে থাকতে যারা কোনোদিন পাড়ার স্টেজ এ গান করেননি বা করতে চাননি তাদের অনেকেই এখন অস্ট্রেলিয়াতে স্বঘোষিত বিরাট শিল্পী। একটা সময় জানতাম গুন্ কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না, আর এখন শুনছি নিজের ঢোল নিজেকেই বাজাতে হবে যাতে লোকে গুনের কথা জানতে পারে। যাই হোক এই সব গায়ক গায়িকারা আবার নিজেদের মত করে টেরিটরি তৈরি করে নিচ্ছে যাতে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শক সবসময় পাওয়া যায়। কেউ কেউ আবার বাচ্চাদের গান শেখানোর নামে বাচ্চার বাবা-মাদের যুক্ত করেন। এতে দুটো কাজ হয়, এক. বাবা-মাদের পরিচিত (যারা বাসায় নিয়মিত দাওয়াত খায়) লোকজন দর্শক হিসেবে আসবে, দুই. অনুষ্ঠান আয়োজনে আর্থিক এবং কায়িক শ্রমের জন্য বাবা-মারা যুক্ত থাকবে। আমি নিজে দাওয়াত চক্রে এরকম একটি গ্রূপের সাথে যুক্ত ছিলাম, যেখানে অনুষ্ঠানের আগে আমাদের বলা হতো কমপক্ষে ৫টা পরিবার নিয়ে আসতে হবে। যেমন, ধরুন একটি সংগঠনে যদি ১০/১৫ টি বাচ্চা যুক্ত থাকে তাহলে বাবা-মা হচ্ছে ২০/৩০ জন, সেই সাথে পারিবারিক বন্ধু হচ্ছে ৬০/৭০ জন, আর ২০/২৫ জন সাধারণ দর্শক ধরলে সব মিলিয়ে ১০০ জন। এই সংখ্যাটা একটি ছোট খাটো অনুষ্ঠানের জন্য মোটামুটি ভালো। বাচ্চাদের গান শেখানো বা শিল্পকলায় উদ্ভূদ্ধ করা অবশ্যই মহৎ উদ্যোগ, বিশেষকরে বিদেশের মাটিতে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে টেরিটরি নিয়ে। নিজেদের অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য সংগঠনের অনুষ্ঠানে এইসব বাচ্চাদের ও বাচ্চার পরিবারকে যেতে দেয়না। অনেক সময় সরাসরি বারণ না করে অনুষ্ঠানের দিন রিহ্যার্সাল অথবা দাওয়াত দিয়ে রাখে। এরপরেও কেউ যদি অন্যদের অনুষ্ঠানে যায় তাহলে তাকে আর সংগঠনে গ্রহণ করা হয়না। এরাই আবার তাদের বড় অনুষ্ঠানের আগে দাওয়াত খাইয়ে লোকজনের কাছে অনুষ্ঠানের টিকেট বিক্রি করে, যাতে চক্ষু লজ্জা থেকে আপনি টিকেট কাটতে বাধ্য হন।
অস্ট্রেলিয়াতে আমরা যারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত, যারা চাই এখানকার বাচ্চারা বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠুক তাঁদের প্রতিনিয়ত অনেক ধরণের বাঁধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ‘নাই দেশে শেয়াল রাজা’ ধরণের কিছু শিল্পীদের এরকম আচরণের পাশাপাশি কিছু লোকজন ধর্মীয় বিধিনিষেদের কথা বলে বাচ্চাদের এবং লোকজনকে গানবাজনা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। অথচ এদের কারো কারো ছেলে মেয়ের বিয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে হিন্দি গানের সাথে নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন। নিজেরা আবার কাওয়ালি আর গজল শুনছেন মোহিত হয়ে। আমার কলেজের এক সহপাঠী খুব ভালো গান করতো। ২য় বর্ষে ওঠার পর দেখেছি সে পাঞ্জেরী শিল্প গোষ্ঠীর কলেজ শাখার সভাপতি। এরপর সে কাওয়ালি ছাড়া আর কোনো গান পরিবেশন করতো না। জিজ্ঞেস করলে বলতো বাংলা গান হিন্দুদের গান, তাই গাওয়া যাবে না। আমি প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছি গান সৃষ্টি হয়েছে মানুষের একতার জন্য। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বেতার কেন্দ্রের গান মুক্তিযোদ্ধাদের এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিলো যাতে নিজেরা প্রাণ দিতেও কুন্ঠা করেনি। যারা আজকে ধর্মের দোহাই দিয়ে গান বাজনা থেকে নিজেদের এবং অন্যদের দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে, তারাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হিন্দুদের ষড়যন্ত্র বলে যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলো। এই অন্যায়কে এবং অন্ধকার থেকে দেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব সানজিদা খাতুনও বলেছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন এর বিকল্প নেই। নয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয় যখন এখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাচ্চারাও নিজেদের উগ্রবাদে জড়িয়ে ফেলবে।
অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশীদের অনেক সংগঠন আছে যারা বিভিন্ন শহরগুলোতে বাংলাদেশী বিখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তাদের মূল উদ্দেশ্য যাই হোকনা কেনো তাদের মাধ্যমে আমরা অস্ট্রেলিয়াতে বসে বাংলাদেশী শিল্পীদের পরিবেশনা সরাসরি উপভোগ করতে পারছি। কিন্তু কিছু লোক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তাদের এই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্থ করতে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অষ্ট্রেলিয়ার প্রধান শহরের মধ্যে সিডনী, মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, ক্যানবেরাতে বাংলাদেশীদের অনেক সংগঠন রয়েছে যাঁরা বাংলাভাষা সহ আন্তর্জাতিকভাবে ভাষা সংরক্ষনের নামে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করছেন। এদের কাছে আমার ব্যক্তিগত ভাবে জানার আগ্রহ এই কর্মকান্ডে বাংলাভাষার তথা অস্ট্রেলিয়ার বাংলা সংস্কৃতির কতটা উপকার হচ্ছে? নিজেদের কম্যুনিটি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ানদের মাঝে পরিচিত করার যতটুকু সুযোগ আপনারা নিচ্ছেন, তার একটা শতাংশ যদি অস্ট্রেলিয়ার বাংলা সাংস্কৃতিক পরিবেশ রক্ষার জন্য ব্যয় হতো তাহলে বাংলাদেশীদের পরবর্তী প্রজন্ম আজকে স্কুলে অস্ট্রেলিয়ার বখাটে ছেলেদের মত নেশাগ্রস্থ হতোনা। এইসব ছেলেমেয়েরা না পারছে অস্ট্রেলিয়ানদের মতো করে বড় হতে না পারছে বাংলাদেশী হিসেবে বেড়ে উঠতে। এরা বড় হচ্ছে এক বিভ্রান্ত পরিবেশে। এদের অনেকেই মুখে বাংলা বলতে পারলেও অনেকেই বাংলা লেখা পড়তে পারেনা। আমার এক নিকট আত্বিয়ের ছেলে একবার একা দেশে যাবার সময় ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে টয়লেট করতে গিয়ে মহিলা টয়লেটে ঢুকে পড়েছিল। এরপর পুলিশ তাকে আটকে রাখার পর সে বাংলা লেখা পড়তে পারেনা জেনে পরে তাকে ছেড়ে দেয়। তাই শুধু ছেলে মেয়েদের বাংলা শেখার জন্য বাংলা স্কুলে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করলেই চলবেনা, ছেলেমেয়েরা বাঙালি মানসিকতার কিনা সে ব্যাপারে খোঁজ রাখা অনেক জরুরি। সাধারণত যেসব ভাষার বর্ণমালা নেই, যেসব ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়না সেসব ভাষা মুখে মুখে বলা হলেও একসময় এইসব ভাষা বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী হারিয়ে যাবে। সেই হিসেবে বাংলা ভাষা এখনো পর্যন্ত হারিয়ে যাবার সম্ভবনা কম। কিনতু প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতি যদি হারিয়ে যায় তাহলে বাংলা ভাষাও হারিয়ে যাবে সেদিন আর বেশী দূরে নয়।
তাই আসুন আর দেরী না করে নিজেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরির জন্য একধাপ এগিয়ে রাখি।
(নিউটন মুহুরী, ক্যানবেরা )