বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের মূল হোতা স্বামীরাই

বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের মূল হোতা স্বামীরাই

বাংলাদেশে নির্যাতিত নারীদের প্রায় ৭০ ভাগই স্বামীর হাতে নির্যাতিত হন, আর এর মধ্যে মাত্র দু শতাংশ প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন সংস্থার দ্বারস্থ হন। ঢাকায় যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার ওপর এক কর্মশালায় এই তথ্য দেয়া হয়েছে।

প্যারিস ভিত্তিক দাতব্য সংগঠন মেডস্য সঁ ফ্রঁতিয়ে এমএসএফ এই কর্মশালার আয়োজন করেছিল।

সরকারি একজন কর্মকর্তা সেখানে বলেছেন, নারীর বিরুদ্ধে এধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের ধারণা কার্যকর ভূমিকা রাখছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই উদ্যোগ ভালো হলেও নির্যাতনের খবর গোপন করা, অজ্ঞতা এবং মানসিকতার সমস্যার কারণে সুফল মিলছে না। ফলে কমছে না নারীর ওপর নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়ন।

বাংলাদেশে সহিংসতার শিকার নারীদের সহায়তার জন্য সরকারি উদ্যোগে চালু হওয়া ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার কিভাবে কাজ করছে?

কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে একটি বাসে করে যাওয়ার সময় সহযাত্রীর দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছিল এক কিশোরী। পেছনের সিটের যাত্রী সেটি দেখে কাউকে কিছু না বলে মোবাইলে কল করেন ১০৯ নম্বরে। বাসটি যখন কক্সবাজারের কাছে তখনি পুলিশ গিয়ে সামনে দাঁড়ালো। বাস তল্লাশি করে সেই কিশোরী আর অভিযুক্ত নিপীড়নকারীকে নামিয়ে থানায় নিয়ে গেল। আর একই সময়ে ফোনে বিস্তারিত জানানো হল মেয়েটির মা-কে।

আজ ঢাকায় প্যারিস ভিত্তিক সংস্থা মেডস্য সঁ ফ্রঁতিয়ে বা এমএসএফ- এর উদ্যোগে যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতার সেবা-পরিসর ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আয়োজিত এক কর্মশালায় অংশ নিয়ে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের মাল্টি সেক্টরাল রেসপন্স ফর ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ড: আবুল হোসেন।

তিনি বলেন যৌন হয়রানি বা পারিবারিক সহিংসতা কোন ঘটনার শিকার ব্যক্তি নিজে বা প্রত্যক্ষদর্শী কেউ যদি ১০৯ নম্বরে কল দেন তাহলে সেটি পাবে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার। সেখানকার কর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে তা জানাবে পুলিশকে এবং সংগ্রহ করবে ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম। প্রয়োজন হলে সেন্টার থেকেই ব্যবস্থা হবে কাউন্সিলিং-এর আর যোগাযোগ করা হবে আইনজীবীর সাথে।

মিস্টার হোসেন বলেন, “এটা হাসপাতাল ভিত্তিক কর্মসূচি। ভিকটিম এখানে তিন থেকে সাত দিন থাকতে পারবে। তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা, কাউন্সেলিং, লিগ্যাল সহায়তার বিষয়টি দেখা হয়। ভিকটিমরা কল দিলে সব তথ্যই পাওয়া যাবে যে তার কোথায় যাওয়া উচিত। আমরাই প্রয়োজনে আইনজীবী ও এনজিওর সাথে তাদের সংযুক্ত করে দেই।”

তবে যৌন ও নারী নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে কমিউনিটি ভিত্তিক একটি মডেলের কথা বলছে এমএসএফ। সংস্থার একজন কর্মকর্তা ফারহানা নাজনীন বলছেন এ মডেলের মূল উদ্দেশ্য সেবাকে নিপীড়িত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়া ।

তিনি বলেন, “আমরা প্রথমেই নিশ্চিত করি ভিকটিমের মানসিক সামাজিক যত্ন আর সাথে চিকিৎসা সেবা। একই সাথে আমরা চেষ্টা করি যে সে লিগ্যাল সাপোর্ট সহ অন্য সহায়তাগুলো কিভাবে পেতে পারে।”

তবে বাংলাদেশে ঠিক কত নারী প্রতি বছর পারিবারিক সহিংসতা বা যৌন হয়রানির শিকার হয় তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী গত বছর ৩৯৪ জন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে যার মধ্যে স্বামীর হাতে নিহত হয়েছে ১৯১ জন। আর একই সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭২৪ জন আর ধর্ষণ চেষ্টা হয়েছে আরও ৬৫ জনের ওপর।

তবে এর বাইরেও বহু নারী আরও নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আইসিডিডিআরবি’র যৌন ও লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড: রুচিরা তাবাসসুম বলছেন যৌন ও নারী নির্যাতনের বেশিরভাগ ঘটনাই গোপন থেকে যায়।

তিনি বলেন, “জরিপ বলছে বাংলাদেশের ৭০ ভাগ নারী কোনও না কোনভাবে নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে। আর নির্যাতিতদের মাত্র দু শতাংশ প্রতিকার পেতে এগিয়ে আসছেন।”

জেন্ডার ও ডাইভারসিটি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ফারজানা শাহনাজ মজিদ বলছেন নির্যাতনের প্রতিকারের ক্ষেত্রে অজ্ঞতার বিষয়টিই এখনো বড় একটি বড় চ্যালেঞ্জ আর এর সাথে আছে নির্যাতনের শিকার নারীকে উল্টো দোষারোপ করার প্রবণতা।

তবে বিশেষজ্ঞসহ কর্মশালায় অংশ নেয়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা একমত যে যৌন হয়রানির প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির এগিয়ে আসা আর সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সেটি নিশ্চিত করা গেলেই হয়রানি প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির প্রকৃত সহায়তা নিশ্চিত করা যাবে বলে মনে করেন তারা। ( বিবিসি বাংলা)