সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা সহ্য করবো না’

সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা সহ্য করবো না’

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করলে সেটা আমরা সহ্য করবো না। আমি জনগণের কাছে বিচার চাই, পাকিস্তানের সঙ্গে কেন তুলনা করা হলো? যে পাকিস্তানকে আমরা যুদ্ধ করে হারিয়েছি, যে পাকিস্তান একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র, সে পাকিস্তানের সঙ্গে কেন তুলনা করবে? সেটা আমি জনগণের কাছে বিচার দিচ্ছি। জনগণের আদালতের বিচারই বড় বিচার।’

সোমবার (২১ আগস্ট) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত ও নিহতদের স্মরণে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ সব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, হঠাৎ করে উচ্চ আদালত থেকে নানা রকম কথাবার্তা, হুমকি-ধমকি ও রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। আমার অবাক লাগে তাদের আমরাই নিয়োগ দিয়েছি, রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন। পার্লামেন্টকে হেয় করা এবং পার্লামেন্টকে নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করার অর্থ কী? আমরা অনেক সংগ্রাম করে, অনেক রক্ত দিয়ে এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে এসেছি।’

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মহিলা (নারী) সংসদ সদস্যদের সংসদ নির্বাচন করতে পারবে না, এ বিষয়ে উনি রায়ে বলেছেন। রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করে সংসদ। সেই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতিকে। উনার তো এই কথা বলার আগে পদত্যাগ করার দরকার ছিল। উনার লেখা রায়ে অনেক কন্ট্রাডিকশন আছে।’

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের প্রধান বিচারপতির রায়ে সংসদ সদস্য সম্পর্কে মন্তব্য, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সংবিধানের কোনও কোনও অনুচ্ছেদ–যেগুলো সংবিধানের মূল কাঠামো, সেগুলো উনার পছন্দ নয়। উনার পছন্দ জিয়াউর রহমান মার্শাল ল’ দিয়ে যেটা করে গেছেন সেটা। আমার একটা প্রশ্ন, পুরো আদালতের সব দায়িত্ব উনার হাতে দিতে হবে? তিনি কী করবেন? জয়নাল আবেদীন জজ ছিলেন। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার যে রিপোর্ট তিনি (জয়নাল আবেদীন) দিয়েছিলেন, বলতে গেলে বিএনপি সরকারের ফরমায়েশি রিপোর্ট তিনি দিয়েছিলেন।’

বিচারপতি জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের উদ্যোগের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জয়নাল আবেদীনের দুর্নীতির তদন্ত করবে দুদক। প্রধান বিচারপতি চিঠি দিয়ে দিলেন, দুর্নীতি তদন্ত করা যাবে না। আদালতে বিচার চাইতে গেলে উনি কথা বলতে পারেন। দুদককে উনি কিভাবে না করেন? একটা দুর্নীতিবাজকে রক্ষা করা প্রধান বিচারপতির কাজ নয়।’ দুদককে দেওয়া চিঠিতে ওই বিচারপতি ‘অনেক রায় দিয়েছেন’ বলে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে মর্মে খবর প্রকাশ পেয়েছে তার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রায় দিলে তার বিচার করা যাবে না এটা কোন ধরনের কথা? এটা কিভাবে হয়? এই চিঠি লিখলেন কিভাবে? তার মানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল হলে বিচার হবে না?

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফেরানোর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকার প্রধান বলেন, ‘বিএনপির আমলে এমন এমন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, দেখা গেল সার্টিফিকেট জাল। এমন অনেক ঘটনা আছে। ছাত্রদলের দুই নেতা কাঁধে নিয়ে রায় পড়ে শোনাচ্ছেন এ রকম জজও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের রক্ষা করার জন্যও কি উনি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল চাচ্ছেন? তারপরও তো রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাও উনি নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ একমত হয়ে সংশোধনী পাস করেছে। আর সেটা এক কলমের খোঁচায় বাতিল করে দেওয়া! তাহলে ওই দুজনই সব জানেন, বাকিরা কিছুই জানেন না।’

 

প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তার মতো মানুষ অ্যাটর্নি জেনারেলকে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়েছেন, যেটা আমার মুখে আনতে লজ্জা লাগে। কোর্টের অবস্থা উনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যাকে নিয়োগ দিলেন তিনি আবার রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছেন। যে ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে, সেই ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারছেন না বলেই গোসসা করে অ্যাটর্নি জেনারেলকে গালাগালি করছেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তানকে আমরা যুদ্ধে হারিয়েছি। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যা করে পাকিস্তানের দালালরাই ক্ষমতায় এসেছিল। আমরা যারা বাবা হারিয়েছি, মা হারিয়েছি, ভাই হারিয়েছি, বিচার চাওয়ারও সুযোগ ছিল না। ইনডেমনিটি দিয়ে বিচার চাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। হাজার হাজার নেতা-কর্মী হত্যা করা হয়েছে। আমরা সেই অবস্থা থেকে একটা সুস্থ, শান্তিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছি।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে আমাকে তো হত্যা করবেই, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দেবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে ধ্বংস করে দেবে এই ছিল লক্ষ্য। রক্ষা করার মালিক আল্লাহ। একশ বছর লাগে নাই, তার আগেই ক্ষমতায় এসেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে ফেরার পর থেকে আমার ওপর বার বার হামলা হয়েছে। যখনই কোনও হামলা হবে, তখন বিএনপি নেতারা বিশেষ করে বিএনপি নেত্রীর বক্তব্যগুলো আমি খেয়াল করি। ওই গ্রেনেড হামলার আগে পার্লামেন্টে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য ছিল আরেকটা ১৫ আগস্ট হবে, আমার বাবা যে পথে গেছেন, আমিও সেই পথেই যাবো। গ্রেনেড হামলার পর আমাদের নেতা-কর্মীরা যখন আসল আহতদের সহযোগিতা করতে, তখন তাদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস মারা হয়েছে। এটা মারার উদ্দেশ্য ছিল যারা হামলাকারী তারা যেন নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারে।’

শেখ হাসিনা আরও বলেন, কারাগারের পাশে কিছু গ্রেনেড দেখানো হলো। যাদের দিয়ে হামলা চালানো হয়, তাদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ ছিল। ঘটনার যাতে কোনও রকম আলামত না থাকে, তা নষ্ট করার জন্য সিটি করপোরেশন থেকে গাড়ি নিয়ে এসে পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়। দুটি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছিল। আলামত হিসেবে সেগুলো রাখা হয়নি। সেই হামলায় আহতরা বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে গিয়ে চিকিৎসা পায়নি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে বিএনপি মনোভাবাপন্ন কোনও ডাক্তার উপস্থিত থাকে নাই, চিকিৎসা দেয় নাই। আওয়ামী লীগমনস্ক ডাক্তাররা সেখানে আমাদের লোকজনদের চিকিৎসা দিয়েছিল।

আমরা চেষ্টা করেছি আহতদের চিকিৎসা দিতে। কিন্তু সরকার তখন নির্লিপ্ত। বিএনপি তখন আমাদের সংসদে কথা বলতে দেয়নি। বরং খালেদা জিয়া ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “উনাকে আবার কে মারতে যাবে?” আর বিএনপি নেতারা বলেছিল, আমি নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে বিস্ফোরণ করেছি।

যখন জনগণের চাপ সৃষ্টি হলো, তখন জয়নাল আবেদীন নামে একজন বিচারককে প্রধান করে কমিটি করা হলো। উনি বলে দিলেন, বিদেশি প্রতিবেশীরা এটা করিয়েছিল। তারপর নোয়াখালীর একজনকে ‘জজ মিয়া’ নাম দিয়ে নাটক সাজানো হল। তাদের আচরণ প্রমাণ করে তারা জড়িত।’

এর আগে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডে ৮ মাস তার শ্বশুরবাড়িতে ছিল। ১ আগস্ট সে ওই বাসা থেকে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় যায়। আমার কাছে একটা খবর এসেছিল, ওই বাড়িতে রাতের বেলা কিছু পেটি নামানো হয়েছিল। পরে আবার রাতেই সেই পেটিগুলো নিয়ে যাওয়া হয়।

১৩টা গ্রেনেড ছুঁড়েছিল, একটা ফাটেনি। আরেকটা ফেটেছিল কিছুক্ষণ পরে। আরজেস গ্রেনেড সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করে যুদ্ধের ময়দানে। প্রকাশ্যে এভাবে একটার পর একটা গ্রেনেড মারা হলো। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ছিল। তাদের ভূমিকা কি ছিল?’

ওইদিন আওয়ামী লীগের ৭০০-৮০০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছিলেন জানিয়ে দলটির সভাপতি বলেন, ‘মঞ্চে কয়েকজন ছিল, যারা আজও  স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে। অনেকেই সেই যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেছে। আমি যখন গাড়িতে উঠি, তখনও গুলি ছোড়া হয়। সেই গুলিতে আমার ব্যক্তিগত সহকারী মাহবুব মারা যায়। সেই দিনের হামলায় যারা মারা গেছে তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি তো সব সময় উত্তরপাড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন উত্তরপাড়া সাড়া দেয়নি, তখন জ্বালাও-পোড়াও করে নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেছে।’ ( বাংলা ট্রিবিউন)