ভালোবাসা দিবস হোক সার্বজনীন   

ভালোবাসা দিবস হোক সার্বজনীন   

ভালোবাসা দিবস’ বা ভ্যালেন্টাইন’ডে হচ্ছে ভালোবাসা প্রকাশ ও নিবেদনের একটি দিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় দিনটি শুধু প্রেমিক প্রেমিকারাই পালন করে থাকে। এজন্য সারা বিশ্বে বিশেষ করে প্রেমিক প্রেমিকারাই এই দিবসটি পালনের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়ে থাকে। কিন্তু প্রতীকী অর্থে বিষয়টি শুধু যুগলদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে সার্বজনীন ভালোবাসার জন্য উন্মুক্ত করা হলে মনে হয় দিনটির গ্রহনযোগ্যতা হবে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু প্রেমিক প্রেমিকা একে অপরকে প্রেম নিবেদন করার মাঝেই এ দিনের সার্থকতা নয় বরং একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসা প্রকাশের মাঝেই এর সার্থকতা। সত্যিকার অর্থে ফুল, পাখি, লতাপাতা ও প্রানিকুলের মতো মানব-মানবী ও প্রকৃতিরই অংশ। অন্যান্য সুন্দর বিষয় ভাললাগার মতো মানব-মানবীর ও একে অপরকে ভাললাগতে পারে কোন পার্থিব আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই। পারিবারিক বন্ধন ছাড়াও বন্ধুত্ব বা মানবিক সম্পর্ক থেকেও ভালোলাগা সৃষ্টি হয়। চিন্তা, কল্পনা, ধারণা ও অনুভুতিকে ঘিরে সে ভালোলাগার জন্ম। ভালোবাসা দিবসে হোক সে ব্যাপক উচ্চ মানসিক ভাললাগা ও ভালোবাসার সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার আয়োজন। এদিন মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে বস্তুগত ও পার্থিব কোন উপহার ছাড়াই।

নানা ব্যস্ততা ও দৈনন্দিন সামাজিকতার ভিড়ে দায়িত্ব ও কর্তব্যর চাপে আমরা সবাই একসময় দূরে সরে যাই প্রতাহিক স্নিগ্ধ ভালোবাসা থেকে।  মন, চিন্তা বা কল্পনার জগত বলে যেহেতু একটা জগতের অস্তিত্ব আছে ভালোবাসা হলো সেই মন, চিন্তা ও মানসিক জগতের অংশ। চিন্তা ও মন থেকে মানুষ পরস্পর পরস্পরকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারে, একান্ত ভাবে অনুভব করতে পারে এবং সেখানে পার্থিব চাওয়াই সব কিছু নয়। ভালোবাসা পরস্পরের প্রতি কখনোই অধিকার আরোপ করেনা, প্রতিদান আশা করেনা শুধু অনুভুতি থাকে অপ্রতিরোধ্য। বিশুদ্ধ ভালোবাসা কেবল শাররিক প্রাপ্তিতেই সীমাবদ্ধ নয়, এর বাইরেও এই অনুভুতি প্রবল। এটি একটি উচ্চতর মানসিক প্রাপ্তি।

এই দিনটি পালনের পেছনে আছে মহান আত্মত্যাগের গল্প। ভালোবাসা দিবসের অন্যান্য সব প্রচলিত কল্প কাহিনীর মধ্যে যে গল্পটা বেশি জনপ্রিয় সেটা হল- রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস সেনাবাহিনিতে লোকবল বাড়ানোর চিন্তা করলেন। এই জন্য তিনি হঠাৎ যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ করেন। তার মতে, বিয়ের ফলে তরুণরা পিছিয়ে পড়ে, ভালো যোদ্ধা হতে পারে না। সম্রাটের এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বসেন ভ্যালেন্টাইন নামে এক খ্রিষ্টান পাদ্রি। তিনি গোপনে যুবকদের বিয়েতে উৎসাহ দিতে থাকেন ও গোপনে বিয়ের আয়োজনও চালিয়ে যেতে থাকেন। একসময় ধরা পড়ে গেলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু কারাগারে তার সাথে এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ের দেখা হয়। চিকিৎসার মাধ্যমে ভ্যালেন্টাইন তাকে সুস্থ করে তোলেন। এরপর মেয়েটির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। মন দেয়া নেয়ার এক পর্যায়ে সম্রাট বিষয়টি জানতে পারেন। প্রেমের সম্পর্কের অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং তা কার্যকর করা হয় ২৭০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। মৃত্যুর আগে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন মেয়েটিকে একটি চিঠি লেখেন, সেখানে তিনি চিঠির সমাপ্তি টানেন ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন’ বলে। পোপ প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যালেন্টাইনকে সেন্ট হুড প্রদান করেন এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসাবে ঘোষণা করেন।

এ দিবসটি নিয়ে একটি কাল্পনিক গল্প ও বেশ প্রচলিত। সেটি ছিল কোন এক গ্রীক নগরীতে এক সাধারণ যুবক সে সময়কার রাজকুমারীকে ভীষণ ভালোবাসতো। রাজকুমারী শর্ত দিলো তাকে পেতে হলে ভালোবাসার পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। সে পরীক্ষাটি ছিল তাকে একটি লাল গোলাপ এনে দিতে হবে। তখন ছিল শীতের সময়। সারা রাজ্য জুড়ে কোথাও লাল গোলাপ ফোটেনি। অনেক খোজা খুঁজির পর যাও একটি গোলাপ পাওয়া গেলো সেটি তাও সাদা। লাল গোলাপ না পেয়ে যুবকটি সেই সাদা গোলাপের পাশে বসে বসে কাঁদতে লাগলো। তার দুঃখ ভরাক্রান্ত অসহায় অবস্থা দেখে একটি নাইটেঙ্গেল পাখির ভীষণ মায়া হল। সে কাছে এসে তার কান্নার কারন জানতে চাইলো। যুবকটি কারণ বলার পর নাইটেঙ্গেল পাখিটি বলল সে তার বুকের রক্ত দিয়ে সাদা গোলাপটি লাল বানিয়ে দেবে। যুবকটি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। দেখল সত্যি সত্যি নাইটেঙ্গেল পাখিটি গোলাপের কাঁটায় তার বুক চিড়ে রক্ত ঝড়তে দিলো সাদা গোলাপের উপর। এভাবে সারারাত পাখিটি তার বুকের রক্ত দিয়ে সাদা গোলাপটি লাল বানিয়ে দিয়ে নিজে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। এই লাল গোলাপের বিনিময়ে যুবক তার ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেয়সীকে জয় করলো। এই ভালোবাসার পিছনে ছিল নাইটেঙ্গেল পাখিটির আত্মত্যাগ। সেদিন ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি তাই সেদিনটিকে থেকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

ভালবাসা একটা অনুভুতি, আমরা যখন কোন ভালো শিল্পকর্ম, ছবি বা গান শুনি আমাদের মনে একটা অনুভুতি জাগে। এই অনুভুতি অদ্ভুত ও রহস্যময়। সেখানে কোনও লোভ বা আকাঙ্ক্ষার ছোঁয়া থাকেনা। সে অনুভুতি অন্তর্গত ও অপ্রকাশ্য। সে ভাললাগা ও ভালবাসা সম্পূর্ণ অপার্থিব। কোন মানুষকে ভালোলাগার পেছনেও এই অনুভূতি কাজ করে। আর সেক্ষেত্রে শাররীক সৌন্দয্য, বয়স কিংবা জেন্ডার কোন বাধা নয়। দুজন মানুষ পরস্পর পরস্পরের সান্নিধ্য, চিন্তা-চেতনা ও মানসিক ঐক্যর ভিত্তিতেও একে অপরের একান্ত আপন হতে পারে। তখনই তৈরি হয় ভালোবাসা ও অকৃতীম বন্ধুত্ব। ভালোবাসা দিবস হোক সেই অনুভুতি সর্বস্ব সার্বজনীন বন্ধুত্ব ও মানবতার।

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় শব্দগুলোর মধ্যে একটি হল ভালোবাসা। তা হতে পারে বিভিন্ন রকমের-  বাবা, মা, ভাইবোন, প্রিয়-সন্তান, বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা, ধর্মীয় ভালোবাসা, পরিবার, সমাজ এমনকি দেশের জন্যও ভালোবাসা। পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণির মধ্যে ভালোবাসা বিদ্যমান। সত্যিকার ভালোবাসায় যৌনকামনা বা শারীরিক লিপ্সা একটা গৌণ বিষয়। এখানে মানবিক আবেগটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভালোবাসা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য নয়। আবেগধর্মী ভালোবাসা হয় অনেক গভীর, সে হলো বিশেষ কারো সাথে নিজের সমস্ত অনুভূতি ভাগ করা। তাই ভ্যালেন্টাইন’ডে বা ভালোবাসা দিবস বিষয়টা কেবলই যদি এককেন্দ্রিক না রেখে সার্বজনীন হিসেবে পালন করা যায় অর্থাৎ প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভালোলাগা ও ভালোবাসার মানুষকে বিশেষ ভাবে স্মরণ করবে সেদিন। যে কোন সম্পর্কই হোক না কেন মানুষ তার প্রিয় মানুষকে ভালোবাসা জানাবে সেদিন বিশেষ ভাবে। যদিও ভালোবাসা একদিনের জন্য নয়, ভালোবাসা দরকার প্রতিদিন প্রতিক্ষন। তারপরও জন্মদিন যেমন বিশেষ দিন ভালবাসা জানানোরও একটা বিশেষ দিন থাকুক তা সবারই ভালোলাগে। ভালোবাসা দিবস হোক সেই পবিত্র অনুভুতিময় সার্বজনীন বন্ধুত্বের দিন।

কাজী সুলতানা শিমি