পূরবী পারমিতা বোস:
ও আয় রে ছুটে আয় পূজোর গন্ধ এসেছে
ও আয় রে ছুটে আয় পূজোর গন্ধ এসেছে
ঢ্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে
গাছে শিউলি ফুঁটেছে কালো ভ্ৰমরা জুটেছে। …..
এই গানের মতোই ছিল আমাদের ছোটবেলার পূজার দিন গুলো। আমাদের বাড়ির উঠোনের কোনায় ছিল বিশাল একটা শিউলি ফুলের গাছ। আর তাতে সাড়া আশ্বিন মাস জুড়েই চলতো শিউলি ফোঁটার ধুম। একটু একটু শীত ভাবের সাথে রাতের বেলায় হিম পড়তো। ভোরবেলায় হিমে ভেজা উঠোন ভরে থাকতো ঝরা শিউলিতে। বাতাসে ভাসতো শিউলির সুবাস মাখানো পূজার গন্ধ। দিনের বেলা আকাশ থাকতো ঝকঝকে নীল। কুয়াশা শিউলি,নীল আকাশ জানান দিতো দূর্গা পূজার আগমনী বার্তা।
হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য বারো মাসে তেরো পার্বন কথাটি প্রচলিত থাকলেও শারদীয়া দূর্গা পূজাই হলো সবচেয়ে বড় পুজো,যা কিনা সার্বজনীন ভাবে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়।আশ্বিন মাসে যে দুর্গা পূজা করা হয় শারদীয়া দূর্গা পূজা ।তবে চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষেও যে দূর্গা পূজা করা হয়,তা বাসন্তী পূজা । তবে শারদীয়া দূর্গা পূজাই হলো হিন্দুদের প্রধান পূজা। হিন্দু শাস্ত্র মতে দেবী দূর্গা হলেন শক্তিরূপিনী ,দূর্গতিনাশিনী।দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য তিনি আবির্ভুত হয়েছেন। মহীষাসুরের অত্যাচারে দেবতারা যখন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত, তখন ত্রিশক্তিরূপের ব্রহ্মা ,বিষ্ণু ও মহেশ্বরের ঐশ্বরিক তেজরস্মী থেকে সৃষ্টি হয় এক আলোক,সেই আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভুত হন যে দেবী তিনিই মহামায়া দেবী দূর্গা।দশ হাত তার দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত করা হয় অসুরকে বধ করে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে শান্তি স্থাপনে।এই আদ্যাশক্তি হলেন মহামায়া মা দূর্গা।
দূর্গা পূজা মুলতঃ বাঙালিদের পূজা।বাঙালিরা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মতোই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বসতি গড়ছে সাত সাগর তেরো নদী পেড়িয়ে। একই মানুষ একই আকাশ তবুও মনে পড়ে শেকড় ছিড়ে ফেলে আসা নদীর তীরে কাশের বন,শরতের নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা আর তার সাথে মহামায়ার আগমনী সুর। হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে হিন্দুদের আনন্দ উৎসব সার্বজনীন এই পূজা বয়ে নিয়ে আসে সর্ব মঙ্গলের বার্তা। যাবতীয় অসুন্দর কে সুন্দর করার প্রয়াসে অসুরত্ব দমনে , বিশ্বমানবতার সুখ শান্তি কামনায় ,মঙ্গলময় পৃথিবীতে সৌহার্দ্য গড়াতে করা হয় মা মহামায়ার বন্দনা।
দূর প্রবাসে বসেও মনে বাজে মহালয়ার ভোরে মায়ের আগমনী সুরধ্বনি। আমাদের বাড়িতে মহালয়ার আগের রাতে সকলকেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে ,তা না হলে ভোরবেলায় আকাশবাণী কোলকাতা রেডিও থেকে প্রচারিত মহালয়ার অনুষ্ঠান শুনতে সকাল সকাল ওঠা যাবে না.আধো অন্ধকারে সারা বাড়িতে গমগম করে বেজে উঠতো সেই স্বর্গীয় সুর যা দেবী সর্বোভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতাঃ নমস্তস্যই নমস্তস্যৈ নময় নমোঃ মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত মনের ভেতর ঢাকের গুরু গুরু বাদ্যি বাজার ধ্বনি। কেনাকাটার ধুম আর দর্জিবাড়ি যাবার পালা।সকাল বিকাল দুইবার করে যেতাম আমরা দল বেঁধে। টুকরো কাপড় এনে রাখতাম নিজের কাছে, স্কুলের ব্যাগে ,বালিশের তলায়। মা মাসিরা ব্যস্ত হতেন নাড়ু ,মোয়া আর সন্দেশ বানাতে। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল দুর্গাবাড়ী। সেখানে কাঠামো পূজা দিয়ে শুরু হতো মায়ের মূর্তি গড়ার কাজ।ফাঁক পেলেই দৌড়ে যেতাম মূর্তি বানানো দেখতে।পুজোর আগের রাতে চক্ষুদান ছিল আরেক আকর্ষণ। চক্ষুদানের সাথে সাথেই মা হবেন জাগ্রত।ষষ্ঠী বা সপ্তমী পূজার অত গুরুত্ব বুঝতাম না। তবে অষ্টমীতে সাজসাজ রব উঠতো যেন।সবচেয়ে ভালো জামা পরে উপোস থেকে ছুটতাম অঞ্জলি দিতে।কে কার আগে দাঁড়াবে।মায়ের পায়ে কে ঠিকঠাক ফুল ছুড়ে দিতে পারবে তা নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। সন্ধ্যায় আরতি নৃত্যের সাথে ঢাকের বাজনা আর মাইকে জনপ্রিয় সব গানের শব্দে শহরে বইতো আনন্দ বন্যা। অষ্টমী নবমীর রাতে দল বেঁধে পূজা।দেখতে যেতাম সবাই।ঘন্টা হিসেবে রিক্সা ভাড়া করা হতো। সব রিকশা চলতো একসাথে সারি বেঁধে। দশমী আসতো মন খারাপ করা এক করুন সুর নিয়ে।তখন ঢাকের বাদ্যি তেওঁ থাকতো এক করুন সুর।থেমে থেমে বাজেট সেই বাজনা।সিঁদুর খেলা শেষে সবার চোখের জলে মিষ্টি মুখে বিদায় নিতেন দেবী মা।আমরা ফিরতাম ঘরে।তবে বিজয়ার আনন্দও ছিল।মিষ্টির দোকান গুলোতে বিশেষ লাড্ডুবানানো হতো।বড়রা সেই লাড্ডু নিয়ে যেতেন আত্মীয়দের বাড়ি বিজয়ারপ্রণাম ও শুভেচ্ছা জানাতে।আমরা প্রণাম করে প্রণামী আর হাতে পেতাম লাড্ডু। আমাদের সময় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বিজয়ার শুভেচ্ছা ,প্রণাম জানিয়ে দূরের আত্মীয়দের চিঠি লিখা।এখন আর কেউ কাউকে বোধহয় চিঠি লিখে না।
প্রবাস জীবনেও পূজা আসে সপ্তাহ শেষে।মায়ের মূর্তি ধুপ ধুনো ফুল বেলপাতা ,সাজগোজ খাওয়াদাওয়া সবই আছে শুধু নেই ফেলে আসা ছেলেবেলাটা।আনন্দময়ীর আগমনে সেজে ওঠে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তর।অনাবিল আনন্দে ভোরে ওঠে মনপ্রাণ।তাই কায়মন বাক্যে প্রার্থনা করি মহামায়ার মঙ্গল স্পর্শে সারা বিশ্বের সকলের মনে জেগে উঠুক সম্প্রীতি ভাতৃত্ববোধ ,কেঁটে যাক সকল অমঙ্গল আঁধার ,অশুভ শক্তির হউক পরাজয়।মায়ের মহিমার বারিধারায় সকল পাপ কেটে মানুষের মন হউক শান্ত শীতল। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণতায় সবাই থাকুক সবার পাশে। যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতাঃ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নময় নমঃ পরিশেষে সবাই কে জানাই শারদীয়া দূর্গা পূজার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা ।