অনেকদিন আগে একটা ফরাসি সিনেমা দেখেছিলাম। লা গ্লোরি দ্যে পিয়েরে.সম্ভবত আঙ্কারায় এক চলচ্চিত্র উত্সবে. ছবিটা দেখতে দেখতে আবেগ-তাড়িত হয়েছিলাম খুব। বিষয়টা একেবারেই সার্বজনীন। প্রতিটা শিশুই তার বাবাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ মনে করে এবং একটা সময় তার এই বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারনাটি ভাঙ্গতে শুরু করে – তখন সে খুব দুঃখ পায় – ব্যথাতুর হয় খুব। আমার শৈশবের শেষের দিকে এবং কৈশরের শুরুর দিকে এরকম ব্যথাতুর হবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন ঘাতক দালাল নির্মূল নিয়ে চারিদিকে খুব হইচই। আমি আব্বাকে জিজ্ঞাস করে বসলাম আব্বা কেন মুক্তিযুদ্ধ করেনি। আব্বা সে মুহুর্তে কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে কোনো যুতসই জবাব দিতে পারেনি। জবাবটা আমি এখন খুব ভালো করে জানি. ডালপালা ছড়ানো বিশাল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষের পক্ষে যুদ্ধে যাওয়া কঠিন ব্যাপার। তাছাড়া যুদ্ধ সবাই করতেও পারেনা। আব্বা অবশ্য যুদ্ধপরবর্তী সময়ে রাজাকারদের বিরুদ্ধে সরকারের হয়ে মামলা লড়েছেন অনেক।আব্বার মুক্তিযুদ্ধ না করার দুঃখ আমি ভুলে গেছি অনেক আগেই। শৈশবের শ্রেষ্ঠ মানুষ আব্বা এখন আবার আমার শ্রেষ্ঠ মানুষ।
পেশায় আইনজীবী হবার কারণে স্বভাবজাত স্বাধীনচেতা চরিত্রটি আব্বার অফিসিয়াল চরিত্র। আমার এই প্রায়-পঞ্চাশ বছরের জীবনে আব্বাকে কখনো চাপে পড়তে দেখিনি। চাপে হয়ত পড়েছেন – কিন্তু সে চাপের ছাপ আচরণে পরেনি কখনো। বয়স আশির কাছাকাছি হলেও মনের বয়স আমার অর্ধেক। এইত কয়েক মাস আগে স্থলপথে টাঙ্গাইল থেকে ট্রেনে/বাসে করে আসাম ঘুরে এলেন। ভুল পরেননি। ভারতের আসাম ঘুরে এলেন।
গ্রামের ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে আসাম গেলেন – সবার নিষেধ সত্ত্বেও. উদ্দেশ্য ছিল প্রায় সত্তুর বছর আগে বাবার সাথে আসাম ভ্রমনের পুনরাবৃত্তি করা। আব্বা আসাম গেলেন এবং রাস্তায় থেমে আজলা ভরে পান করলেন বেকি নদীর শীতল-ঠান্ডা পানি – যেমনটি করেছিলেন সত্তুর বছর আগে বাবার হাত ধরে।
আব্বা এক অদ্ভূত কম্বিনেশনের মানুষ ।নিজের মত করে কোরান পড়েন এবং অর্থ করেন। যাকে বলে মুক্তমনের ধার্মিক মানুষ। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বিপুল আগ্রহ এবংঅগাধ ভালবাসা। পৃথিবীর যে কোনো বিষয়ে আব্বার সাথে অবাধে আলাপ করা যায়। যৌবনে আব্বা ভরাট কন্ঠে বুক ফুলিয়ে দর্শক মাতিয়েছেন ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি করে। শৈশবে মুগ্ধ হয়ে শুনেছি আব্বার দরাজ গলায় ‘ কারার ওই লৌহ কপাট’ কিংবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ নাই আসে’। আব্বার কন্ঠে শোনা ‘কাজলও নদীর জলে’ আমরা সব ভাইবোন এখনো গুনগুন করি।
বাবাকে নিয়ে এতসব লিখছি কারণ – এই রবিবার ছিল বাবা দিবস. আমিও একজন বাবা, তবে কোনো ভাবেই আমার বাবার ধারেকাছের মানের বাবা না। আমার মেয়েটা, যে এখন প্রায়-পনের, ছোটবেলায় আমাকে এত ভালবাসত যে, আমাকে একদিন হাঁটু গেড়ে জিজ্ঞেস করলো ” বাবা উইল ইউ মেরি মি”. আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম – একেবারে তব্ধ লাগা যাকে বলে। আমার আদরের এই রাজকন্যা মেয়েটার লা গ্লোরি দি পিয়েরের মতন বাবাপ্রিতির ঘোর কেটে গেছে কিছুদিন হলো। এখন আমরা বিবাদ-ঝগড়া করে কাটাই প্রতি নিয়ত। গাড়িতে অতুল প্রসাদ নাকি টেইলার সুইফট বাজবে নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যায়।আমাকে বিয়ে করবেতো দুরের কথা – বরং মাকেই জিজ্ঞেস করে মা কোন দুঃখে আমাকে বিয়ে করেছিল।
আমার ছেলেটা নয় হব হব করছে। ওর কাছে এই নরাধম ‘ দি বেস্টেস্ট ফাদার অফ দি হোল ইউনিভার্স’। বোঝাই যাচ্ছে বাবাপ্রিতির ঘোর এখনো কাটেনি ওর। আমি অবশ্য পুত্রের সাথে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করি। খুব মজা পাই, নিজের ছোটবেলা খুঁজে পাই। বিনা কারণে পুত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি – আর ভাবি ছোটবেলায় বুঝতাম না আব্বা কেন আমার দিকে এভাবে বিনা কারণে তাকিয়ে থাকত।
জন্মদাতা এবং বাবা দুটি ভিন্ন জিনিস – আলাদা ব্যাপার। বাবা মানে নিঃশর্ত আবদার শোনা – বাবা মানে যে কোনো মূল্যে সন্তানের মঙ্গল চাওয়া – মঙ্গল করা। বাবা মানে বিনা কারণে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে সৌভাগ্যবান মানুষ মনে করা।
( ইমতিয়াজ কায়েছ রিশা, সিডনি থেকে)