মেইলটা খোলার শক্তি আঙ্গুলের ডগায় নাই মনে হল । সর্বশক্তি প্রয়োগ করলাম মাউসের মাথায় । ক্লিক শব্দের সাথে সাথেই হার্টের শব্দও প্রতিধ্বনিত হল ছোট্ট রুমটাতে । মেইল পড়ার গতিটা আলোর গতিকেও ফেল করে দিল । মেইলটার সারমর্ম ছিল এরকম ” মনোবসু তোমাকে সিলেক্ট করেছে, তুমি আসতে পার আমাদের ল্যাব এ ” । মনে হচ্ছিল তিড়িং বিড়িং করে লাফাই । রুমে সহকর্মী বিদ্যমান । সংবরন করলাম নিজেকে । কাকে জানাব প্রথমে ? সহধর্মীনী তখন দিনাজপুরের সরকারি কলেজের লেকচারার ! এখনকার দিনের মত তখন তো মোবাইল ছিল না । একমাত্র ভরসা কুরিয়ার সার্ভিস ! সেটাও তিনদিন ।প্রফেসরকে ধন্যবাদ দিয়ে রিপ্লাইয়ের কাজটা সেরে ফেললাম । চা টা অমৃতের মত লাগলো । সময় আর যায় না । মনে হচ্ছিল আজই ইস্তফা দেই চাকুরিটার । মালিক ডাকলে সোফায় তো বসবই সাথে পায়ের উপর পা তুলে বসে বেয়াদবির চরম প্রমান দিব । বেয়াদবির যতই প্লান করি না কেন ওগুলো আমার দ্বারা সম্ভব নয় সেটা আমি ছাড়া আর কে বুঝবে ? ৮ ঘন্টার অফিসটাকে ৮০ ঘন্টার মত মনে হয়েছিল । মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত আমাকে ডক্টরেট বানানোর সবচেয়ে বেশী আগ্রহী যে মানুষটি সেও হাজির যথাসময়ে । শুরু হল জাপানে আসার প্রস্তুতি । ঘরের একটা জায়গায় ছোটখাট মার্কেট খোলা হল । চাল, ডাল , লবণ , পেয়াজ, পোশাক আশাক সবই স্থান পেল সেই মার্কেটে । বরফের দেশে যাচ্ছি তাই শীতের কাপড়ের প্রতি আমার চেয়ে ওনার ঝোঁকটা একটু বেশী । ঠান্ডার ঠ ও যেন আমার ত্রিসীমানায় আসতে না পারে তার জব্বর ব্যবস্থা করলেন । বঙ্গবাজারের সবচেয়ে মোটা জ্যাকেটটা কিনে ফেললেন । বাসায় কম্পিটিশন শুরু হল কে কতক্ষন পরে থাকতে পারে জ্যাকেটটি ? মার্কেটিংয়ের দৌড়ে আমার ব্যাংক ও মানিব্যাগ দুটোই ফাকা হতে সময় লাগেনি । হাত পাততে হয়েছিল এদিক সেদিক । নিউ মার্কেট থেকে কেনা বিশাল সাইজের ট্রাভেল ব্যাগে জায়গা হচ্ছিল না মাল সামানার । কিন্তু ওনার মার্কেটিং বন্ধ হচ্ছে না ! মনে হল পুরো বাংলাদেশেটাই আমার সাথে পাঠিয়ে দিবেন জাপানে ।
বন্ধুদের কাছে বিদায়, আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াতে আমার শুকনা শরীরটা মোটা হতে লাগলো । এয়ারপোর্টে পৌঁছেই টের পেলাম দেশ ছাড়ছি । লাগেজের সাইজই বলে দিচ্ছে বোর্ডিং পাস নিতে ঝামেলা হবে । ভাগ্যিস বন্ধু দীপক ছিল । ও এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে ম্যানেজ করে দিল । দেশ শুধু আমিই ছাড়ছিলাম না, বিলু ভাই ও যাচ্ছিলেন আমার সাথে । দুজনের চোখে তখন নায়াগ্রার প্রবাহ । কখন যে টেকঅফ করেছি টের পাইনি । ঝাপসা চোখে জানালা দিয়ে নদীগুলোকে দেখে বুঝে গেলাম যাত্রা শুরু হয়েছে । দেখতে দেখতে বুড়িগঙ্গাকে গুগল ম্যাপের নদীর মত মনে হল । মেঘেরা এসে সরু নদীটাকেও আড়াল করে দিল । যদিও জানি তিন বছর ছয় মাস দেখতে দেখতে চলে যাবে, তবু মনে হচ্ছিল দেশটা মনে হয় আমাকে আর গ্রহন করবে না । আমি কি ভাবি না ভাবি, প্লেনের টিভি মনিটরে কিন্তু থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্টের অবস্থান দেখাচ্ছে । ব্যাঙ্ককে ট্রানজিট ছিল পাঁচ ঘন্টার মত । বিলু ভাই টোকিওর যাত্রী হওয়ায় উনি বিদায় নিলেন আগে ভাগেই । একা একা থাইল্যান্ডের বিশাল এয়ারপোর্টের এক মাথা থেকে অন্য মাথায়,কতবার যে রাউন্ড ট্রিপ দিয়েছিলাম মনে করতে পারছি না । বন্ধু তারিকের ভাষায় ভয়কাতুরে মাহবুব আজ এত সাহসি হলো কিভাবে । কমলাপুর স্টেশনে টিটি কে দেখে যে দশবার পকেটের টিকেট চেক করতো, সে কিনা বীর দর্পে হাটছে থাইলান্ডের এয়ারপোর্টে । দেশ ছাড়ার কষ্ট, নতুন দেশে যাবার আনন্দে মনের অবস্থান ঠিক কোথায় বুঝতে পারছিলাম না । টাইফুন নামক শব্দটার কারনে আনন্দ কষ্টকে ছাপিয়ে চিন্তা নামক বিষয়টি মনে বাসা বাধল । আমার জাপান ভিজিটের আগেই টাইফুন নাকি ভিজিট করছে জাপানে । টাইফুনের বেড়ানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্লেন থাইল্যান্ড ছাড়বে না । পৌঁছাতে পারব তো ? রিসার্চ আমাকে দিয়ে হবে তো ? যন্ত্রপাতির বারোটা বাজাবো না তো? কেউ রিসিভ করতে আসবে তো ? চিন্তার লিস্টটা ক্রমশই বাড়ছে। যখন প্লেনে আসন নিলাম থাইল্যান্ডে তখন মধ্যরাত্রী । ক্ষুধায় পেট চো চো করছে । কিপটামির কারনে সাথের ডলারগুলোকে অক্ষত রেখেছি । বৌয়ের দেয়া খাবার প্লেনের পেটে গন্ধ ছড়াচ্ছে । কাছে রাখার ব্যাগটাতে ঢুকাতে ভুলে গিয়েছিলাম । বিমানবালাদের সরবরাহকৃত খাদ্যের প্যাকেটের গায়ে হালাল শব্দটা দেখে আবারো মনে হল দেশ ছেড়েছি । এখন থেকে হালাল হারাম শব্দ দুটো খুবই জরুরী । প্লেনের ভো ভো শব্দ , আশে পাশে নাক ডাকার শব্দ আমার লুলাবাই এর দায়িত্ব নিল । বিমানবালাদের নকল হাসিতে চোখের ঘুম যখন পুরাপুরি দুর হল, তখন সুর্যের লাল আভা দেখা যাচ্ছিল জানালা দিয়ে । বইতে পড়া সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের আকাশে পৌছে গেছে আমাকে বহনকারী বিমানখানা ।