ভালই চলছিল জাপানে দৈনন্দিন জীবন! শনি ও রবিবার বাদে সাইকেলে দশ কিলোমিটার প্যাডেল ঘোরাই । সপ্তাহের এই দুইদিন সাপ্তাহিক বাজার কিংবা আডডা দিয়েই সময় কাটাই । শরীর পুরাপুরি ফিট ! সন্ধ্যায় টেবিল টেনিস খেলি । প্রতিপক্ষ পিংপংয়ের দেশের, মানে চীন দেশের ছেলে মেয়েরা ! ছেলেদের সাথে টেবিল টেনিস খেললে গিন্নী আপত্তি করে না । প্রতিপক্ষ মেয়ে হলেই সময় অসময়ে খোটা দেয় । প্রতিপক্ষ যাতে মেয়ে না হতে পারে তাই গিন্নীও টেবিল টেনিসের ব্যাট তুলে নিল হাতে । নবিশকে ট্রেনিং দিতে যেয়ে আমিও ভুলে গেলাম যেটুকু শিখেছিলাম হল লাইফে !
রোগ বালাই ধারের কাছেও আসে না । বাংলাদেশে থাকাকালীল এন্টাসিডের ফাইল সাথে থাকতো সবসময় ! বাংলাদেশ থেকে আনা এন্টাসিড ট্যাবলেটের পাতাগুলো ইনটেক থাকা অবস্থায় এক্সপাইরি ডেট দেখলো । সর্দি সর্দি ভাব হলে প্যারাসিটামলেই কাজ হয় । মনে মনে ভাবি অসুখ বিসুখ নাই, কেন অযথা ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে টাকা দিব । ইন্সুরেন্সের টাকা দেয়া বন্ধ করার কথাও মাথায় এসেছিল । উপরওয়ালার মনে হয় পছন্দ হয়নি আমার এই চিন্তাধারা । একরাতে টেবিল টেনিস শেষ করে বাসায় ফেরার পথে পেটে একটু ব্যাথা অনুভব করলাম। খাবারে অনিয়ম হয়েছে ভেবে পাত্তাই দিলাম না । আমি পাত্তা না দিলেও ব্যাথা কিন্ত থামল না । ছোটবেলা থেকেই রোগ বালাইয়ের বেলায় ছিলাম উদাসীন । ক্ষুধা লাগলে কান্নাকাটি করতাম কিন্তূ জ্বরটর হলে ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতাম । আব্বার ঔষুধের বক্স থেকে নিজেই একটা দুটো ট্যাবলেট বের করে খেয়ে ফেলতাম । সেদিন রাতের ব্যাথাটা কমার কোন লক্ষন না দেখিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ছিল । গিন্নীকে শুধু জানালাম পেটটা ব্যাথা করছে । সারারাত ঘুমোতে পারিনি। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছি প্রচুর কিন্তু মুখটা ছিল মিউট ।
আমাদের আবাসস্থলটা ছিল মেইন সিটি থেকে একটু দুরে । বড় হাসপাতাল নাই তবে ক্লিনিক আছে । জাপানী ভাষাজ্ঞান দু বছরের বাচ্চাদের সমান । সেটা দিয়েই ক্লিনিকের ডাক্তারকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম । ব্যাথায় আমার অভিব্যক্তি দেখেই ডাক্তার জাপানীজে রোগের নামটা বললেন । আমাকে চিন্তিত দেখে জাপানীজ টু ইংলিস ডিকসনারীতে দেখালেন ইংরেজি নামটা । এপেনডিসাইটিস । নামটা পরিচিত । আত্মীয় স্বজনদের দুএকজন এ রোগে ভুগেছে । হোমিত্তপ্যাথি ও আয়ুর্বেদে ভাল হয়েছে অপারেশনের টেবিলে না যেয়েও । এখানে তো ঐ দুটো চিকিৎসা আছে কিনা জানা নেই । ডাক্তার পরিষ্কার জাপানীতে বুঝিয়ে শুধু ইংরেজিতে লিখলেন অপারেশন । এও বললেই এই ক্লিনিকে হবে না দশ কিলোমিটার দুরের সিটির ক্লিনিকে যেতে হবে ।
গিন্নীর কাজ! গিন্নী গিয়েছে কাজে। আমি গেলাম সিটির হাসপাতালে। ল্যাবে জানালাম পুরো ব্যপারটা । হাসপাতালে ভর্তি হয়েই প্রোডাকশন লাইনের প্রোডাক্টের মত লাইনে দাড়িয়ে গেলাম । গার্মেন্টসের প্রোডাক্টের মত এক সেকশনে রক্ত নিয়ে দেখিয়ে দিল আর এক সেকশনের রাস্তা । সেখানে কানে দুল লাগানোর ছিদ্র করার মত কানের লতিতে সুঁচ ঢুকিয়ে দেখলো রক্ত কতক্ষনে বন্ধ হয় । সবধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে বেডে এসে দেখি প্রফেসর, এসোসিয়েট ও গিন্নী অপেক্ষমান । নার্সের সাথে কথাবর্তা শেষে প্রফেসর ও ওনার কলিগদের মুখ চেপে হাসতে দেখলাম । অপারেশনের টেনশনে হাসার কারণ খোজার চেষ্টা উধাও হল ।
জাপানে চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যয়বহুল যদি হেলথ ইনসুরেন্স না থাকে । বাচ্চাদের চিকিৎসা খরচ নাই বলেলেই চলে । প্রথম দুবছর সব অঞ্চলেই ফ্রি । পরবর্তীতে অ্যাডাল্ট হওয়া পর্যন্ত অঞ্চলভেদে খরচটা উঠানামা করে । চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য গুগলি বুবুর কাছে জানতে চাইলে নাড়ী নক্ষত্র বের করে দেবে । তার চেয়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার কথা বলি । এদেশে চিকিৎসা সংক্রান্ত সবকিছুই ভাল শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ নেবার পর বিলটা দিতে একটু বেশী সময় লাগে। সবকিছুই ডিজিটাল হওয়ায় কিছুটা গতি বাড়লেও বিরক্তির মাত্রাকে থামাতে পারেনি এখনো । আমরা ভিনদেশিদের ধৈর্য্যশক্তি কম মনে করতাম । আমার ধারনা ভুল । স্বয়ং জাপানীজদের কাছেও ব্যাপারটা বিরক্তিকরই । যেদেশে ট্রেন বুলেটের গতিতে চলে সেখানে চিকিৎসার বিল নেবার সিস্টেমটা শম্ভুক গতিতে চললে বেমানান তো লাগবেই!
আরেকটা বিরক্তিকর ব্যাপার আছে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকগুলোতে সেটা মনে হয় সব দেশেই। তবে ভাষার কারনে নরমাল বিষয়গুলিও কঠিন হয়ে ওঠে । বাংলাদেশে যেমন ডাক্তারদের কাছে গেলেই হাজারো টেস্টের লিস্ট ধরিয়ে দেয় এখানেও তেমনি হাজারটা প্রশ্নের উত্তর লিখা লাগে ডাক্তারের চেম্বারে গেলে । কিছু প্রশ্ন ব্রড টাইপের হলেও বাকিগুলো মাল্টিপল চয়েসের । কতদিন হলো ভুগছেন? বিড়ি টানেন কিনা? টানলে দিনে কয় প্যাকেট লাগে? মদ পান করেন কিনা? প্রতিদিন জাপানীজ সাকের পরিমান কতটুকু ? বিয়ার কয় ক্যান ? ওয়াইনের পরিমান কতটুকু । ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্র থাকে তবে বেশির ভাগই জাপানীজ । একবার না বুঝেই আমি, আপনি গর্ভবতী কিনা প্রশ্নটার উত্তরে হ্যা এর ঘরে টিক চিহ্ন দিয়েছিলাম । নার্স আমার আপাদ মস্তক ভালো করে দেখে জেন্ডার লেখার জায়গাটাতে আমার সেক্স কনফার্ম করে হেসেছিল মাথা নিচু করে !
আর একটা মেজর অপারেশন হয়েছিল সেই সময় । মেজর এই কারনে বলছি কেননা সেই অপারেশনটাতে সময় একটু বেশীই নিয়েছিল । রোগটার নাম কি ছিল তাও মনে নেই । তবে অপারেশনের টেবিলে আমাকে অচেতন অবস্থায় এক ঘন্টা থাকতে হয়েছিল । রোগটা নাকি আমি নিজেই জন্ম দিয়েছি আমার শরীরে । এটা আমার উক্তি না আমার সহধর্মীনীর । আগে অসুখটা কি সেটা বলে নেই, পরে না হয় গিন্নীর লজিকের প্রমান খোজা যাবে । রোগের সিমটম ছিল কনিষ্ঠ মানে কানি আঙ্গুল ও কানি আঙ্গলের বড় ভাই রিং ফিংগারের ডগার অনুভুতিগুলি কেমন জানি ভোতা হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন । কম্পিউটারের কিবোর্ডে টাইপ করলে স্ক্রীনে অক্ষর ভেসে ওঠে কিন্তু আঙ্গুলের ডগা টের পায় না। গেলাম ডাক্তারের কাছে । ডাক্তার শুকনো তুলি হাতে নিয়ে আমার অবশ আঙ্গলের ডগায় ছবি আকার চেষ্টা করে জানতে চান কেমন লাগছে ।ক্যানভাসের দায়িত্ব নেয়া আমার আঙ্গুল টের পায়না কেমন ছবি অঙ্কিত হচ্ছে আঙ্গলের মাথায় । টের পাচ্ছিনা বলাতেই ছবি আকা বন্ধ করলেন । এক্সরে ফিল্মগুলির দিকে চিন্তিত মনে কিছুক্ষন পর্যবেক্ষণ করে হাতে তুলে নিলেন কলম । টেবিলের উপর ছবি আঁকা শুরু করলেন। এবার কাগজ নিল ক্যানভাসের দায়িত্ব । মরা নদীর মত কিছু একটা এঁকে ব্রীজ আঁকলেন মাঝপথে । আঁকা শেষ করে ছবিটার ব্রীজটাকে দেখিয়ে বললেন সমস্যা এখানে । কি সমস্যা? ব্রীজ ধ্বসে পরবে? না, ধ্বসে পরবে না তবে পানি যাওয়ার পথটাকে সরু করেছে । বাম হাতের কনুয়ের হাড়গুলো চাপ দিয়েছে হাতের নার্ভাস সিস্টেমকে । তাই আঙ্গুলের ডগার অনুভুতি মস্তিষ্কে পৌঁছে না । চিকিৎসা কি? সোজা উত্তর অপারেশন ! কেমন অপারেশন? হাড়দুটোকে তুলে ফেলবেন, নাকি ভেঙ্গে ফেলবেন? বর্ননা শুনে মনে হলো খুবই সিম্পল । চোখের সামনে দেখতে পেলাম শিরিশ কাগজ হাতে নিয়ে কাঠমিস্ত্রিরা কাজে ব্যস্ত । আমার অপারেশনে কাঠমিস্ত্রির দায়িত্বে থাকবে ডাক্তার । শিরিশ কাগজের পরিবর্তে ওনার হাতে থাকবে ডাক্তারের ব্যবহারে হাতুরি বাটাল । কেমন যন্ত্র ব্যবহার করেছে বলতে পারবো না । তবে অপারেশন শেষে টুকরো টুকরো রক্তমাখা হাড়গুলো দেখে মনে হয়েছিল হাতুরি বাটাল ছাড়া সম্ভব হয় নাই । যে যন্ত্রই ব্যবহার করুক না কেন অপারেশনের কয়েকদিন পরে আমার হারানো আঙ্গুলের ডগার অনুভুতি ফিরে এসেছিল । আঙ্গুলের ডগার অনুভুতি ফিরে আসলেও গিন্নীর সমনজারী হয়েছিল কাত হয়ে টেলিভিশন দেখায় ।
অপারেশনের আগে ল্যাব থেকে ফিরেই মেঝেতে কাত হয়ে শুয়েই টেলিভিশনের স্ক্রীনে চোখদুটো স্থির হতো । বাম হাতখানা টেম্পোরারি বালিশের দায়িত্ব নিত । গিন্নী ডাক্তার না হয়েও অভিজ্ঞ ডাক্তারের মত রোগটা হবার কারন হিসেবে দাড় করালো আমার কাত হয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখাকে। প্রমানের জন্য দায়ী করলো দীর্ঘ সময় একই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকাকে । কুনুয়ের হাড় মাথার ভার সহ্য করতে না পেরে চাপ দিয়েছে হাতের নার্ভাস সিস্টেমকে । গিন্নির মনগড়া এই লজিক কতটুকু সত্য জানি না । হলে হতেও পারে! সেটা প্রমানের সুযোগ আর দেয়নি । বাম হাতের কুনুইকে বালিশের পরিপুরক হিসেবে ব্যবহার করতে গেলেই অতীত ইতিহাসের রেকর্ড বাজে গিন্নীর কন্ঠে । বাধ্য হয়েই বাদ দিয়েছি টেলিভিশন দেখার সেই ভঙ্গিকে ! জাপানের দিনগুলির সাথে এই ঘটনার সম্পৃক্ততা খুব একটা নাই । রোগ বালাই বাংলাদেশে থাকলেও হতে পারত । বিদেশের একাকিত্বের বিশাল সময়টাকে ব্যয় করতে আশ্রয় নিতাম টেলিভিশনের প্রোগ্রামগুলিকে । জাপানীজ কমেন্ট্রির কিচ্ছু বুজতাম না । তারপরেও কাত হয়ে কনুইকে বালিশ বানিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখতাম বেজবল খেলা । ক্রিকেট পাগল আমি বেজবলের হোম রানের মাঝেই ক্রিকেটের ছক্কা খুজতাম । স্ট্রাইক, পিঞ্চ হিটার শব্দগুলোকে পরিচিত মনে হত । টাচ আউটটাকে রান আউট মনে করে আনন্দ খুজতাম । বেজবলের নাম এদেশে এসেই প্রথম শোনার মতই নতুন মনে হয়েছিল খেলাটা । বামহাতের নার্ভাস সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে ( গিন্নীর লজিক সত্য প্রমানিত হলে ) ওটার নিয়ম কানুন রপ্ত করেছিলাম । কবে যে এদেশের বেজবল টিম হানসিন টাইগারের ফ্যান হলাম বলতে পারব না । আজ এতদিন পর ক্রিকেট কমেন্ট্রিতে নাক্কল বলের নাম শুনলে খটকা লাগে । কে এই নাক্কল বলের আবিস্কারক? বেজবল নাকি ক্রিকেট ? হবে হয়ত কেউ । মাঝখানে পার হয়েছে অনেকগুলি বছর । বাংলাদেশের মাঠে ছি বুড়ি খেলা মেয়েরা এখন ক্রিকেট খেলে । নাক্কল বল ও ছুড়ে থাকবে নিশ্চয় । জাপানের দিনগুলিতে নতুন নতুন অধ্যায় যোগ হলেও মনটা এখনো খোঁজে বাংলাদেশের সেই মেঠো পথ …
আরো পড়ুন :