ফজলুল বারী:ভারতের মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। ভাটির দেশ বাংলাদেশের হাওরে মেঘালয়ের পানির স্রোত এখন নেমেছে গড়গড়িয়ে। এতে করে ধংস হয়েছে হাওর রক্ষা বাঁধ। এরপর থেকে সুনামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা পর্যন্ত বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে হাওরাঞ্চলের কৃষককূল কাঁদছে।
পানির তোড়ে ধংস হয়েছে হাওরের দূঃখী পরিশ্রমী কৃষকের সোনারঙা ফসল-স্বপ্ন-পরিশ্রম সব। এর মাঝে তাদের আশ্বস্ত করারও কেউ নেই! মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ হিসাবে কৃষক জেনেছে যেহেতু তারা আধাপাক ধান কেটেছে তাই তারা সরকার নির্ধারিত ধানের দাম পাবেননা।
এ নিয়ে দিশেহারা কৃষককে শান্তনা দেবারও কেউ নেই! কৃষিমন্ত্রী নিশ্চয় এখনও হাওরাঞ্চলে যাবার ওহী অথবা নির্দেশ পাননি! তার আবার আগামীতে শাসকদলের সাধারন সম্পাদক হবার বড় সখ নিয়ে এখন অনেক ব্যস্ততা! যদি নির্দেশ পান শরমে না করতে পারবেননা।
সরকারি কৃষক লীগ যেটা আছে এই সংগঠনের সঙ্গে দেশের কৃষকদের নূন্যতম কোন সংযোগ-সম্পর্ক নেই। আসলে দেশের সবকাজ এখন প্রধানমন্ত্রী একা করেনতো। আর অন্যদের যার যার আখের গোছানো ছাড়া বিশেষ কোন কাজ নেই। দেশের অন্যসব সংগঠনের শ্রমিক-কৃষক সংগঠনগুলো এখন দূর্বল।
পৃথিবীতে এখন সমাজতন্ত্র নেই। সে যুগের মতো করে এখন আর নেই শক্তিশালী ক্ষেত মজুর-কৃষক সংগঠনগুলোও। বাংলাদেশের ভঙ্গুর সমাজতান্ত্রিক সংগঠনগুলোর নেতাদের জাতীয়-আন্তর্জাতিক কোন আয়সূত্রও আগেরমতো নেই।
তাদের যারা বাগ্মী, চেহারা ভালো, তারা আপাতত টকশোগুলোর দাওয়াত রক্ষা করে অল্পস্বল্প যা আয় করেন তাই দিয়ে কোনভাবে কষ্টে জীবনরক্ষা করে চলেন! এমন বাম টকারের সংখ্যাও জন দশেকের বেশি নয়। বাকিরা বড় দুটি দলের তৃতীয় সারির নেতা হয়ে কোন রকম করে খাচ্ছেন।
কেউ কেউ গার্মেন্টস নেতা হিসাবে এনজিওশপ খুলেছেন। অবশিষ্ট ঢাকাবাসী সোনালী অতীত কৃষক সংঘ নেতাদের সঙ্গে গ্রামগঞ্জের চাষাভূষাদের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেও চলে। গ্রামগঞ্জের এ যুগের কৃষক-মজুররা এদের প্রয়োজনও জানেননা। কখন সুদি এনজিও কর্মকর্তারা গ্রামে ঢোকে তাদের নিয়ে তারা ভয়ে থাকেন।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে হাওরে আর সড়ক নির্মান করা হবেনা। অতঃপর সবাই বুঝেছেন হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মান করাটা আত্মঘাতী হয়েছে। তা বাধাগ্রস্ত করেছে পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে। এর ধাক্কায় ধংস হয়েছে অবশিষ্ট সব হাওর রক্ষা বাঁধ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব এখন এসব ব্রিফিঙ করেন। তার নির্লিপ্ত উচ্চারন শুনে মনে হবে এই যে হাওরের বুক চিরে এসব মাইলের পর মাইল সড়ক নির্মান হয়েছে এর সঙ্গে বুঝি এই সরকার বা মন্ত্রিপরিষদের কোন সম্পর্কই ছিলোনা! ভাগ্যিস মুখস্ত আর কাউকে দোষ দিয়ে বসেননি ব্রিফিঙ সচিব।
আপনারা দেশের এত উন্নয়নের কৃতিত্ব নিচ্ছেন-পাচ্ছেন। ভুলের দায়-দায়িত্ব কেনো নেবেননা। বড় মূল্য দিয়ে বুঝতে হলো বড় ভুল ছিল অনেক সিদ্ধান্ত! এই কিছুদিন আগেও হাওরের বুক চিরে সড়কের সব ছবি দেখেছেন না ফেসবুকে? জাতীয় মিডিয়ায়! এরসঙ্গে ছিল সব উন্নয়নের ফিরিস্তি!
কত হাজার কোটি টাকার ছিল সেই সব সড়ক প্রকল্প? ঠিকাদার কারা ছিলো? তাদের নাম চেহারা সবাই চেনেন। নাম বললে নাকি চাকরি থাকবেনা! সেই সব প্রকল্প গ্রহনের আগে কী এসব নিয়ে কোন ফিজিবিলিটি স্টাডি হয় নাই? ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া কোন প্রকল্প গ্রহন করা হয়?
কোন পরিবেশবিদ প্রকৌশলী কী ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া এমন প্রকল্পের প্রস্তাবনা করতে পারবেন? জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের যুগে কি সেটাও সম্ভব? কত হাজার কোটি টাকার সড়ক প্রকল্প শেষ হয়েছিল কত হাজার কোটিতে? এসব পাশ করেছিল কারা।
এখন বলা হচ্ছে সেই সড়কগুলো কেটে আরও কত সেতু বানানো যায় সেটাও নির্মান করা হবে! ঠিকাদাররা তোমরা আবার নতুন সেতু নির্মানের কাজ পাবার জন্যে তৈরি হও। যত মাটির বাঁধ ধংস হয়েছে সেগুলো পুনঃনির্মানের ঠিকাদাররা তৈরি হও! আমাদের কোথাও কোন টাকার সমস্যা নেই!
দেশের হাওরাঞ্চলের নানা অঞ্চলে মাটির বাঁধ-পথ নির্মানের মাধ্যমে আত্মঘাতী আরও অপরিকল্পিত যতকিছু নির্মানযজ্ঞের কুশীলবদের চিহ্নিত কে করবে? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নেই। একজন বাস করেন বঙ্গভবনে। লিখিত বক্তৃতা তাকে পড়তে হয়। হাওরে হাজার হাজার কোটি টাকার ভুল প্রকল্পের প্রতিশোধ নিচ্ছে প্রকৃতি।
দেশে এখন সাহস করে সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার কেউ নেই! যত সমস্যা হতভাগা কৃষককূলের। তাদের যে ফসল ধংস হলো এর কোন মূল্য নেই। এগুলান মরেওনা। তারা আধাপাকা ধান কাটলো কেনো এ দোষ তাদের। আধাপাকা ধান মানের ধানের মূল কম পাবে এটা সোজা হিসাব।
সরকারকে তোমরা যত পারো ভারতের দালাল বলতে পারো। কিন্তু সরকারতো আর নরেন্দ্র মোদীকে বলেকয়ে শত্রুতা করে মেঘালয় থেকে পানি চেয়ে আনেনি! এই যে তাদের ধান নিয়ে উদ্বেগ-হাড়ভাঙ্গা খাটা-খাটুনি, উচ্চ রক্তচাপ, এসবের কোন মূল্য নেই! এভাবেইতো আমাদের কৃষকরা শুধু ভূমিহীন হয়।
তারা ভগ্নস্বাস্থ্যের হয়। কারন এসব ফসলের পিছনে কায়িক শ্রম ছাড়াও কোথায় কত বিনিয়োগ-কত ঋণ এসব নিয়ে তাদের চেয়ে বেশি কে জানে! একেকজন কৃষক কয়েকটি এনজিওর কাছে ঋণগ্রস্ত। এক এনজিওর ঋণ নিয়ে আরেক এনজিওর কিস্তিশোধ দেয়। দেশে এত মানুষের ভাগ্য বদলায়, শুধু কৃষক ছাড়া।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ সেলিম বিমানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার ট্র্যাভেল এজেন্সির সংযোগ থাকায় কনফ্লিক্ট ইন্টারেষ্টের কথা বলে তাকে সেই মন্ত্রণালয় দেয়া হয়নি। এখন আর এসব নিয়ে কোন বাছ-বিচার নেই। এখন বানিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী হওয়া স্বত্ত্বেও তাতে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেষ্ট হয়না!
উল্টো তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে বলেন, মাননীয় স্পিকার আমি যে ব্যবসা করি এটা কি আমার দোষ? বানিজ্যমন্ত্রীও ঈমানদার। তিনি শতভাগ সততার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখেন। কিন্তু এদেশে কৃষকের স্বার্থ দেখার কেউ যেন নেই! কৃষিমন্ত্রীও কথা বলেন ব্যবসায়ীদের পক্ষে!
সয়াবিন তেলের দামের সঙ্গে কৃষিমন্ত্রীর কী সম্পর্ক? বাংলাদেশ কী সয়াবিন বীজ উৎপাদন করে? অথচ কৃষিমন্ত্রী বলে দিচ্ছেন সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধি যদি না করা হয় তাহলে ব্যবসায়ীরা যদি সয়াবিন তেল আমদানি না করেন! আহারে এমন ব্যবসায়ী বান্ধব কৃষিমন্ত্রী কি বাংলাদেশ আর দেখেছে?
যিনি কৃষক নয়, ব্যবসায়ীদের চিন্তায় ঘুমাতে পারেননা! এই যে হাওরের কৃষকের ঘরে ঘরে এখন কান্না, কৃষিমন্ত্রীকে কেউ এখনও হাওর এলাকায় দেখেছেন? না স্থানীয় প্রশাসন সব সামাল দেবার পর তিনি যাবেন? দেশের বয়স পঞ্চাশ গড়ালেও বাংলাদেশে জবাবদিহির সংস্কৃতি-লজ্জা কিছুই গড়ে উঠলোনা।