অস্ট্রেলিয়ার যাওয়ার কয়েক দিনের মাথায় এক ব্যক্তিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশি তরুণী মোমেনা সোমা ও ঢাকায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের হাতে গ্রেফতার তার ছোট বোন সুমনা সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের সময় জব্দকৃত ল্যাপটপ থেকে দেশে ও বিদেশে তাদের কয়েকজন সহযোগী সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ইতোমধ্যে তাদের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা একজনকে কড়া নজরদারিতে রেখেছে দেশটির পুলিশ। বাংলাদেশেও তার স্বজনদের সম্পর্কে খোঁজ রাখা হচ্ছে।
জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে পড়াশোনা করার জন্য অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ৯ দিন পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি নিউ সাউথ ওয়ালসে এক ব্যক্তিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরি নিয়ে হামলা চালায় বাংলাদেশি তরুণী মোমেনা সোমা। হামলায় সময় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর তার সম্পর্কে জানার জন্য ঢাকার মিরপুরে তাদের বাড়িতে গেলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তার ওপর ছুরি নিয়ে হামলা চালায় তার ছোট বোন আসমাউল হুসনা সুমনা। তাদের বিষয়ে তদন্তের জন্য অস্ট্রেলীয় ও বাংলাদেশি পুলিশ একে-অপরকে সহায়তা করছে। তারা এই দুজন সম্পর্কে নানা তথ্যবিনিময় করছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। আর গত বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়ার আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়েছে মোমেনা সোমা। আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করার কথা রয়েছে।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা সুমনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্ত করছি। একই সঙ্গে তার বড় বোন মোমেনা সোমার মামলার বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে এই দুই বোনের বেশ কয়েকজন সহযোগীকে শনাক্ত করেছি। তাদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ ও নজরদারি করা হচ্ছে।’
মহিবুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘সোমা ও সুমনা একই ল্যাপটপ ব্যবহার করতো। আমরা তাদের ব্যবহৃত ল্যাপটপ এবং মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা করিয়েছি। সেখান থেকে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব সূত্র ধরেই তদন্ত চলছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী সহযোগিতা করছি। ইতোমধ্যে একটি প্রতিবেদনও পাঠানো হয়েছে। এমনকি তাদের প্রয়োজন অনুসারে কারও সাক্ষীর প্রয়োজন হলে আমাদের তদন্ত তদারক কর্মকর্তা অস্ট্রেলিয়া গিয়ে সাক্ষ্যও দিতে পারে।’
সিটিটিসি সূত্র জানায়, মোমেনা সোমার ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা করে তার কয়েকজন সহযোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ফারাহ ইসলাম নামে এক সহযোগী অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছে। ফারাহ ঢাকার রেডিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে ও এবং এ লেভেল সম্পন্ন করার পর ২০১১ সালে মার্কেটিং ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিষয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ২০১৫ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পরের বছর অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিয়ের পর সে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায়। ঢাকায় থাকার সময় ফারাহ ইসলাম মোমেনা সোমাদের সঙ্গে বসুন্ধরার ওই বাসায় ‘হালাকা’য় অংশ নিতো। হালাকা বলতে একাধিক ব্যক্তি মিলে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা বোঝায়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে ফিরে আসার পর ফারাহ ২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারি আবার অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। ফারাহর সঙ্গে মোমেনা সোমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এমনকি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েও ফারাহ ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে মোমেনা সোমা।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, তাদের সহযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ ফারাহ ইসলামকে শনাক্ত করেছে। অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইলে ফারাহ পুলিশকে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে ফারাহর বাসা থেকে হিযবুত তাহরীরের কিছু সাংগঠনিক বই উদ্ধার করেছে পুলিশ। হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও অস্ট্রেলিয়ায় নিষিদ্ধ নয়। এজন্য তাকে গ্রেফতার না করে নজরদারিতে রাখা হয়েছে ।
সিটিটিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, মোমেনা সোমা, ফারাহ ইসলাম ও গাজী সোহানের ই-মেইল এবং যোগাযোগের বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে জিহাদি ভিডিও শেয়ার করার কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মোমেনা সোমার একটি আইডি ছিল। এছাড়া হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার এবং টেলিগ্রাম অ্যাপস ব্যবহার করতো মোমেনা সোমা। সূত্র জানায়, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে সিটিটিসির কর্মকর্তারা মঞ্জু নামে মোমেনা সোমার চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীর সন্ধান পান। মঞ্জু্ও জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত বলে সন্দেহ করছে সিটিটিসির কর্মকর্তারা। মঞ্জু আমেরিকায় বসবাস করেন। সে ঢাকায় এলে সোমাদের সঙ্গে হালাকায় অংশ নিত। এমনকি আমেরিকাতেও সে হালাকা করে বলে তথ্য পেয়েছে সিটিটিসির কর্মকর্তারা। এছাড়া ফারহানা আলম নামে আরেক নারীর সঙ্গে সোমার যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। ফারহানা প্রাইমারি লেভেলের র্যাডিক্যালাইজড। সে লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক শিক্ষক। লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক অনেক শিক্ষককে জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সূত্র জানায়, জাহানারা বীথি নামে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে মোমেনা সোমার যোগাযোগের তথ্য পেয়েছে সিটিটিসি। জাহানারা বীথি ম্যারেজ মিডিয়া হিসেবে কাজ করতো। সেও মোমেনা সোমার ‘হালাকা’র সঙ্গী ছিল। জাহানারা বীথিও লেকহেড গ্রামার স্কুলের সাবেক শিক্ষক ছিল। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কানিজ রহমান নামে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থীর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল মোমেনা সোমার। তবে কানিজ সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও তথ্য জানাতে পারেননি সিটিটিসির কর্মকর্তারা।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, দুই বোনের মধ্যে বড় বোন সোমা প্রথমে র্যাডিক্যালাইজড হয়। মোমেনা সোমা ২০০৯ সালে ঢাকার লরেটো স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল, ২০১১ সালে মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করে। এরপর প্রথমে সে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু একমাস পরই সে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে ভর্তি হয়। মোমেনার ল্যাপটপ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২০১২ সালে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম ও জিহাদ নিয়ে একটি আলোচনায় অংশ নিয়েছিল। এছাড়া সে ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি থেকে একাধিক শর্ট কোর্স সম্পন্ন করে। ওই অনলাইন ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের সঙ্গেও তার সখ্য ছিল।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, মূলত নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয় মোমেনা সোমা। প্রথম দিকে হিজাব না পড়লেও ২০১৩-১৪ সালে কট্টরভাবে ইসলামিক নিয়ম মানা শুরু করে। ওই সময়ে সে বাসাতে টেলিভিশন চালানোও বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই সে বসুন্ধরা এলাকার এফ ব্লকের একটি বাসায় গিয়ে নিয়মিত ‘হালাকা’ করতো।
সিটিসিটির একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে সিরিয়ায় ফরেন ফাইটার হিসেবে যাওয়া গাজী সোহানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সোমার। সোহান ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর সিরিয়ায় গিয়ে ২০১৫ সালের মে মাসে ফিরে আসে। পরে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় সে। সেই সোহানের মাধ্যমে সোমার পরিচয় হয়েছিল নজিবুল্লাহ আনসারির সঙ্গে। পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নজিবুল্লাহ আইএসে যোগ দিয়ে ইরাকে চলে যায়। পরিচয়ের পর নজিবুল্লাহর সঙ্গে মোমেনা সোমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেও নজিবুল্লাহর পরিবার মেনে না নেওয়ায় বিয়ে হয়নি।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, সোমা সিরিয়ায় গিয়ে নজিবুল্লাহর সঙ্গে দেখা করা ও আইএসে যোগ দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ২০১৪ সালের শেষদিকে মোমেনা সোমা সিরিয়া যাবার জন্য তুরস্কের আতিলিম ইউনিভার্সিটি থেকে বৃত্তিও সংগ্রহ করে। কিন্তু ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার তুর্কি দূতাবাস থেকে তার ভিসার আবেদন খারিজ করা হয়। এরপর ২০১৬ সালে মোমেনা সোমা তিউনিশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তিউনিশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যলয়ে পাঠানো সোমার আবেদনটিও ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার করেছে সিটিটিসি। ছোট বোন সুমনাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, সোমা তিউনিশিয়ায় পড়ার নাম করে সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
সুমনার বিরুদ্ধেশিগগিরচার্জশিট
বড় বোন মোমেনা সোমার হাত ধরে জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়া আসমাউল হুসনা সুমনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনও চলছে। সুমনা জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। সুমনা ২০১৪ সালে ঢাকার মিরপুর গার্লস আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে এবং গ্রিন ফিল্ড স্কুলে এইচএসসিতে ভর্তি হয়। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করে মেন্টরস নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে জিইডি সম্পন্ন করে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তি হয় সে। তার বিরুদ্ধে শিগগিরই চার্জশিট দেওয়া হবে।
আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সুমনা জানিয়েছে, বড় বোন সোমার মাধ্যমে সে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তারা দুই বোন একসঙ্গে অনলাইনে বিভিন্ন জিহাদি ভিডিও দেখতো। বোনের মাধ্যমে তার গাজী সোহান ও নজিবুল্লাহ আনসারির সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছিল। এছাড়া তার বোন অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে তাকে বলে যায়, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে সে আইএসের হয়ে হামলা করবে। যদি তাকে ঢাকার পুলিশ ধরতে যায় তাহলে যেন সেও পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। বড় বোনের কথা মতোই সে সিটিটিসির এক কর্মকর্তার ওপর ছুরি নিয়ে হামলা করেছিল।
দুই বোনকে ‘ডিজওউন’ করছে পরিবার
মোমেনা সোমা ও আসমাউল হুসনা সুমনার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে গ্রেফতার হওয়ার পর পরিবার তাদের ‘ডিজওউন’ করছে। এজন্য ঢাকায় সুমনার জন্য কোনও আইনজীবীও নিয়োগ করা হয়নি। এমনকি কখনও জামিনের আবেদনও করা হয়নি। দুই বোন গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তাদের বাবা জনতা ইন্সুরেন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মনিরুজ্জামান তার ঢাকার মিরপুরে ৩৫৫/১ পূর্ব কাজীপাড়ার বাসা ছেড়ে দিয়ে ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল আজিজের সঙ্গে থাকছেন। ড. আব্দুল আজিজ বলেন, ‘উই ডিজওউন দেম। তাদের আদর্শের সঙ্গে আমাদের আদর্শের কোনও মিল নেই। আমরা এটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। এজন্য আমরা কোনও আইনজীবীও ধরি নাই। তাদের (দুই বোন) কী হবে কী না হবে (বিচারে) তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। ওদের বাবা অসুস্থ। তার চিকিৎসা চলছে। সেও এ বিষয়ে কিছু বলতে চায় না। আমি নিজে শিক্ষক মানুষ। আমি জঙ্গিবাদ পছন্দ করি না। আমি এসবের ধারে কাছেও নেই।’ (সূত্র: বাংলাট্রিবিউন )