অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশী ইতিহাসবিদের সাফল্য অস্ট্রেলিয়ান গণ মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয় । বাঙালিরা কবে ,কখন, কিভাবে প্রথম অস্ট্রেলিয়াতে আসেন এই নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ রেকর্ড, কাউন্সিলের তথ্য ভান্ডার, পুরাতন পত্রিকা নিয়ে গবেষণা করে এবং বাংলাদেশ, কলকাতা ও পাকিস্তান ঘুরে ফিরে ড. সামিয়া খাতুনেই বই “অস্ট্রেলিয়ানামা” এই বছর অস্ট্রেলিয়ায় ইউনিভার্সিটি অফ কুইন্সল্যান্ড প্রেস। বইটির টাইটেল Australianama: The South Asian Odyssey in Australia, by Samia Khatun (University of Queensland Press, 2019). এর আগে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০১৮ সালের জুন মাসে।
বইটির লেখিকা এবং ইতিহাসবিদ ড.সামিয়া খাতুন ২০০৯ সালের জুনে সিডনি ইউনিভার্সিটিতে পি.এইচ.ডি. পড়ার সময় জানতে পান যে নিউ সাউথ ওয়েলসের ব্রোকেন হিল অঞ্চলে এক আদিবাসী গ্রামে একটি মসজিদ রয়েছে। সেই মসজিদে রক্ষিত আছে শত বছরের পুরোনো একটি কোরআন শরিফ।সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় তিনি স্থানীয় কাউন্সিলে যোগাযোগ করেন এবং তাদের কার্যালয় থেকে মসজিদের চাবি নিয়ে বাক্সে রাখা কোরআন শরিফটি হাতে নেন যার মোড়কের ওপর ইংরেজিতে ‘দ্য হলি কোরআন’ লেখা ছিল। যখন প্যাকেট খুলেন, তখন অবাক হয়ে জান এটিত কোরান শরিফ না বরং বাংলায় লেখা একটি পুস্তক যাতে লেখা ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ যার প্রকাশকাল লেখা ১৮৮৭। তারপর মাথায় একটি চিন্তায় ঘুরে বেড়ায়, কি করে এল শত বছরেরও পুরাতন বাংলা একটি বই ব্রোকেন হিল অঞ্চলে ?
অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালিদের পদচারণ অর্ধশতকেরও কম—এমনটাই ছিল এত দিনকার ধারণা। ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ এই বাংলা পুঁথি অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের দুর্গম মরু অঞ্চল ব্রোকেন হিলে কিভাবে এল ,তারই ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেই মাত্র ৩১ বছর বয়সে সামিয়া তাঁর পিএইচডি গবেষণাটিও শেষ করেন।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ইতিহাস রেকর্ডরোম থেকে শুরু করে পুলিশ বিভাগের রেকর্ড ও পুরোনো সংবাদপত্র ঘেঁটে সামিয়া একে একে জানতে পেরেছেন বাঙালিদের ওই অজানা-অচেনা দেশে বিচরণের চাঞ্চল্যকর তথ্য। বাঙালিরা যেমন করে দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপ গিয়েছিল জাহাজে করে ঠিক একই কায়দায় ব্রিটিশ জাহাজের নাবিক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার বন্দরগুলোর কাছাকাছি এসেই সমুদ্রে ঝাঁপ দিতেন তাঁরা এবং বিভিন্ন বন্দরনগরে গিয়ে উঠতেন।
কেউ কেউ আদিবাসী নারীদের বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসতিও গড়ে নিয়েছিলেন আবার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীও হয়ে উঠেন।আবার কেউ সার্কাস দলের সদস্য, কেউ বা রাঁধুনি হিসেবেও নিজেদেরকে অস্ট্রেলিয়া স্থায়ী বাসিন্দা করে নেন। উনিশ শতকে অস্ট্রেলিয়ায় বসত গড়ার এই সকল তথ্য সামিয়ার গবেষণায় উঠে আসে ।
কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা জাহাজগুলোর নাবিক হিসেবে অনেকেই তখন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বন্দরনগরে এসে নেমে যেতেন এবং আর জাহাজে ফিরে আসতেন না। সেই ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই শুরু হয় বাঙালিদের অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন শুরু হয়। ১৯০৭ সালের ৩ ডিসেম্বর আজাদ উল্লাহ নামের এক বাঙালি নাবিক তাঁর সহকর্মী আবদুল্লাহর হামলায় মারা যাওয়ার ঘটনাও ওই সময়টার অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ বিভাগের নথিতে পাওয়া গেছে। ১৮৮২ সালে মেলবোর্নের রাস্তায় দরবেশ নামের একজন খুদে ব্যবসায়ী সম্পর্কেও তথ্য রয়েছে সেখানকার সিটি করপোরেশনের নথিতে। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ কলোনি পোর্ট হের্টল্যান্ডে আবদুল আজিজ নামের এক বাঙালি পাচকেরও খোঁজ পান সামিয়া। খাজা মোহাম্মদ বক্সের জীবনীতে পাওয়া যায়, ১৯০৪ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানকারী ৩০ জন বাঙালি কাপড় ব্যবসায়ীর দেখা পেয়েছেন, যাঁরা জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে সাঁতার কেটে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাঁরা পার্থ শহরের একটি ভবনকে মসজিদ হিসেবেও ব্যবহার করতেন।
১৮৮০ সালে অস্ট্রেলিয়ার মরু এলাকা ব্রোকেন হিলে বিপুল পরিমাণে খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়। ওই খনিজ পরিবহনের জন্য তখন ব্রোকেন হিল থেকে পিরি বন্দর পর্যন্ত ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছিল। সড়ক বা জল কোনো পথ দিয়েই এত বিপুল পরিমাণ নির্মাণসামগ্রী পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্রোকেন হিলে রেললাইন নির্মাণ করতে গিয়ে পণ্য পরিবহনের জন্য উটের ব্যবহার শুরু হয়। তখন কলকাতা বন্দর থেকে আফগান, পাকিস্তানি ও বোম্বে থেকে আসা ব্যবসায়ীরা উটের বহর নিয়ে হাজির হতেন। উট ব্যবসায়ীরা পূর্ববাংলার এক ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন এস এস বেঙ্গল নামের একটি জাহাজ ভাড়া নিয়ে নিয়মিতভাবে অস্ট্রেলিয়ায় উট নিয়ে যেতেন। ওই এস এস বেঙ্গলের নাবিকদের বড় অংশ ছিলেন পূর্ববাংলার অধিবাসী। ওই জাহাজে করে বিপুল পরিমাণে বাঙালি নাবিক অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেয়। কথিত আছে, খান জাদা ও খাজা মোহাম্মদ বক্স বাঙালি নাবিকদের অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রবন্দর থেকে শহরে পালিয়ে যেতে সহায়তা করতেন। এভাবে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রোকেন হিলের স্থানীয় ইতিহাসের রেকর্ডরোম থেকে জানা যায়, ওই সময়কার বুর্কি, মেনেনডি ও উইলকানিয়া শহরে অনেক বাঙালি খুদে ব্যবসায়ীদের দেখা মিলত। স্থানীয় এক ঐতিহাসিক মোহামেট আনামেক (সম্ভবত নামটি বিকৃত হয়ে গেছে) নামের এক বাঙালি সার্কাস দলের সদস্য হিসেবে বিপুল খ্যাতি পেয়েছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ানামা লিখতে গিয়ে তার ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “কাসাসুল আম্বিয়া বইটি আমার জীবনের মোর ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমি বইটি পাইনি বরং বইটি আমাকে পেয়েছে ”
তিনি আরো বলেন, তার জীবনে আরো একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে যায় তার বাবা মায়ের সিডনির বাসায়। তিনিই তার দাদার বাবার কাজী মোতাহার হোসেনের জীবনী নিয়ে লিখে যাওয়া পাণ্ডুলিপিটিও পড়ার সুযোগ পান। উল্লেখ্য যে, কাজী মোতাহার হোসেন বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন। একাধারে তিনি যেমন একজন বিদ্বান বিজ্ঞানী ছিলেন তেমনি লেখক এবং কবি হিসেবে প্রখ্যাত ছিলেন। বর্তমানে ড.সামিয়া খাতুন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস, বাংলাদেশে কর্মরত আছেন।
সূত্রঃ ইফতেখার মাহমুদ ( অন্য আলো , প্রকাশিত ২০১৩), এবিসি নিউজ অস্ট্রেলিয়া , দি ইন্টারপ্রেটার।