ফজলুল বারী: রাজাকারের তালিকায় নিয়ে গোলমাল দেখা দিয়েছে। এর কারনটা আমি ধারনা করতে পারি। তবে এই তালিকা নিয়ে পিছু হটা যাবেনা। সমস্যা-অভিযোগ যা এসেছে বা আসবে তা আমলে নিয়ে তা তদন্ত করে ভুল সংশোধন করতে হবে। সরকার ইচ্ছা করে ভুলগুলো করেছে তা আমি মনে করিনা। বরঞ্চ তালিকা প্রকাশের সাহসী উদ্যোগ নেয়ায় আমি সরকারের প্রশংসা করি। ডক্টর কামাল হোসেন প্রশ্ন রেখে বলেছেন, এতোদিন পরে এসে এই তালিকা কেনো। সরকার দশ বছর ধরে ক্ষমতায়। দশ বছর ধরে এটা করলোনা কেনো। কামাল সাহেবের বয়স হয়েছে। সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন তোলা তার সাজেনা। তিনি নিজেও এক সময় মন্ত্রী ছিলেন। তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেননি। দশ বছর ধরে তিনিতো এটা প্রকাশের দাবিও কোথাও করেননি। না এখানেও আইন ব্যবসার মক্কেল খুঁজছেন? এখন এই তালিকায় আসা কোন রাজাকারের পক্ষ হয়ে তিনি তা তার ল’ফার্ম কোর্টে দাঁড়াবেননা এর গ্যারান্টি কী?
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন বিএনপিকে হেয় করার জন্যে সরকার এই তালিকা প্রকাশ করেছে। চোরের মনে পুলিশ পুলিশ আর কী! এটা কি বলা সম্ভব মির্জা ফখরুলের বাবা মির্জা রুহুল আমিন চখা মিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? দালাল আইন বাতিল করে কারাগারে থাকা রাজাকারদের মুক্তি দিয়ে তাদের নিয়ে দল গঠন করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। রাজাকার শাহ আজিজুর রহমান যিনি একাত্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন, তাকেই কিনা অবিশ্বাস্যভাবে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন ফখরুলের নেতা! বরিশালের রাজাকার আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন খালেদা জিয়া। মিঃ ফখরুল, এসব কথা বললে বিএনপি হেয় হয়? না আপনাদের সম্মান বাড়ে? না বলা সম্ভব এরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? অতএব সবকিছুতে গলাবাজি না করে অন্তত এ ইস্যুতে চুপ থাকাটা মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে আপনাদের।
বিএনপির আরেক গলাবাজ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, রাজাকারদের নেতৃত্বে নাকি রাজাকারের তালিকা করছে আওয়ামী লীগ! হায়রে মুক্তিযোদ্ধাদের দল! তাহলে আপনারা ক্ষমতায় থাকতে তালিকাটি প্রকাশের উদ্যোগ নিলেননা কেনো? যদি বলা হয় এই তালিকায় গোলমাল ঘটানো হয়েছে জামায়াতকে নিয়ে আপনাদের ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে! কী জবাব দেবেন?
ইদানিং বিএনপি নেতারা প্রায় একাত্তরে খালেদা জিয়ার দেশের জন্যে ত্যাগ স্বীকারের কথা বলেন! কী ত্যাগ ছিল খালেদা জিয়ার একাত্তরে? জিয়া চট্টগ্রাম থেকে যুদ্ধে চলে যাওয়ায় স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। হাবিবুর রহমান সানি নামের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আগরতলা থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন খালেদাকে নিয়ে যাবার জন্যে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক কষ্টে-কৌশলে সেনানিবাসের বাড়িতে খালেদার কাছে পৌঁছে জিয়ার লেখা চিঠি তার হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তাঁর সঙ্গে যাননি। বরঞ্চ একাত্তরের মে মাসে ‘বিপথগামী’ সেনা অফিসারদের ফিরে আসার জন্যে খালেদাকে দিয়ে একটি আহবান প্রচার করায় পাকিস্তানিরা। এসবেরজন্যে দেশ স্বাধীন হবার পর জিয়া-খালেদার সম্পর্কে কী সমস্যা হয়েছিল, সমস্যা কিভাবে মিটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাতো সবাই জানেন। যুদ্ধে যাবার কারনে পাকিস্তানিরা কর্নেল তাহের সহ অনেকের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু জিয়ার গ্রামের বাড়ি বা সেনানিবাসে খালেদার ঘরে কেউ কেনো একটি ঢিলও ছুঁড়লোনা কেনো, এসব উটকো ঘাটাঘাটি করে সামনে আনার হঠাৎ সখ হলো কেনো মির্জা ফখরুলদের?
প্রকাশিত তালিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি গোলমালের অভিযোগ এসেছে বরিশাল থেকে। বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তী, তাঁর মা শহীদ জায়া উষা রানী চক্রবর্তীর নাম এসেছে রাজাকারের তালিকায়। অথচ তপনেরর বাবা সুধির কুমার চক্রবর্তী একাত্তরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর স্ত্রী হিসাবে উষা রানী মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পাচ্ছেন। বরিশালের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক মিহির লাল দত্ত সহ আরও অনেকের নাম চলে এসেছে রাজাকারের তালিকায়। মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তীর মেয়ে ডা মনীষা চক্রবর্তী বাসদের আলোচিতা নেত্রী। তিনিও আগ বাড়িয়ে বলে ফেলেছেন সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে এই তালিকা করেছে! এটা ঠিক নয় মনীষা। আপনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বিষয়টিকে এত সরলীকরন করা বোধ হয় ঠিক হলোনা।
এখন দেখা যাক তালিকায় এ ধরনের ভুল কিভাবে হলো। এটা রাজাকারের তালিকা সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। তবে আমার ধারনাটি সঠিক নাও হতে পারে। ১৯৭১ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নানা রকম তালিকা করেছিল। রাজাকারের তালিকা তারা দুই কারনে করে। রাজাকারদের যেহেতু ভাতা দেয়া হতো এবং তাদের নামে অস্ত্র বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল সে কারনে তাদের নামের তালিকা হয়। এর বাইরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আরেকটি তালিকা হয় দুষ্কৃতিকারীদের। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা তাদের কাছে ছিল দুষ্কৃতিকারী। তখন কম্পিউটার না থাকায় তালিকা করার সহজ মাধ্যম ছিল টাইপ রাইটার মেশিন। এজন্য সরকারি অফিসগুলোতে টাইপিস্টের পদও ছিল। করণীক তথা কেরানিদের অনেকেও টাইপ জানতেন বা জানতে হতো। কাজেই যেহেতু এসব তালিকা কোন গবেষকদের হাতে হয়নি তাই টাইপিস্ট অথবা করণীকদের ভুলে এক তালিকায় আরেক তালিকার নামও টাইপ করা হয়ে যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, রাজাকারের তালিকা এসব টাইপ করে ঢাকায় পাঠানো হয়। মুন্সিগঞ্জ থেকে টাইপ করে পাঠানো রাজাকারের তালিকার একটি কপি নিজের সংগ্রহ থেকে বের করে আমাকে দিয়েছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমদ। এমনিতে আমি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকারের তালিকা সংগ্রহ করেছিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভ্যু করার সময়। এলাকার কারা কারা মুক্তিযোদ্ধা, কারা কারা রাজাকার ছিলেন এটা তারা স্মৃতি থেকে বলতেন। এখন প্রকাশিত তালিকাটি হাতে নিয়ে এলাকায় এলাকায় গিয়ে এর ভুলক্রটি যাচাইবাছাই করা সম্ভব। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যকরী সভাপতি শাহরিয়ার কবীর এরমাঝে এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এলাকা ভিত্তিক কাজটি করার মোটামুটি একটি নেটওয়ার্ক নির্মূল কমিটির আছে। কারন এলাকায় এলাকায় প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিকরা মূলত নির্মূল কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কাজেই এ কাজটি সাহস এবং সততার সঙ্গে নির্মূল কমিটির পক্ষেই করা সম্ভব। কাজেই কিছু ভুল হয়েছে বলে কোনভাবে এই তালিকা থেকে সরে আসা যাবেনা। কারন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কোনভাবেই বলেননি এটি চূড়ান্ত তালিকা। এ তালিকা হাতে নিয়ে মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত তালিকাটি করা সম্ভব। এ নিয়ে ঘোট পাকানোর আগেই সরকারের তরফে এমন একটি ঘোষনা আসা উচিত।