এক মজনু এবং লক্ষ ধর্ষক

এক মজনু এবং লক্ষ ধর্ষক

ফজলুল বারী: এক ধর্ষনের ঘটনা আড়াল করিয়ে দিয়েছে সবকিছুকে! পিঁয়াজের দামের আবার ডাবল সেঞ্চুরি, টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশে ভাষন, দুর্নীতির মামলায় দন্ডিত খালেদা জিয়ার পক্ষে ডক্টর কামালের মামলা লড়ার ঘটনা সবকিছু আড়াল করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার দাবানল বা ইরান-আমেরিকার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার নিউজও আড়াল হয় প্রায়! কারন ধর্ষনের শিকার মেয়েটি দেশের সবচেয়ে বনেদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে প্রতিবাদের সূচনা হয় তা আরেকটি সর্বাত্মক ছাত্র-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আভাস দিচ্ছিলো। মামলার তদন্তের মুখস্ত দায়িত্ব ডিবিকে দেয়া হলেও প্রায় ক্লু লেস একটি ধর্ষনের ঘটনার রহস্য উদ্ধার-আসামী গ্রেফতারে আইনশৃংখলা বাহিনী সমূহের অঘোষিত নীরব প্রতিযোগিতা ভালো লেগেছে। এবং সবাইকে ছাড়িয়ে সবার আগে আসামী গ্রেফতারে সাফল্যের জন্যে র‍্যাবকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও অভিনন্দন। আবার প্রমান হলো রাস্তার আন্দোলন ছাড়া চটজলদি দাবি আদায় হয়না। সহিংস আন্দোলনের চাইতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অনেক বেশি শক্তিশালী এবং কার্যকর।
ধর্ষক মজনুকে গ্রেফতারের আগে অনেকে যার যার কল্পনা প্রতিভার প্রমান রাখছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়! ধর্ষকের চুল ছোট, উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি বৃত্তান্তের সঙ্গে তনু হত্যার সূত্র মিলিয়ে বলার চেষ্টা হয়েছে এই কোন বাহিনী সদস্য ছাড়া হতেই পারেনা, ওটা বাহিনীর এলাকা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কল্পনা প্রতিভাধরদের বড় একটি ঘাটতি এখানেও ধরা পড়ে গেলো! ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতা দিয়ে সম্ভবত বাংলাদেশের কোন বাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত হওয়া যায় না। মিনিমাম উচ্চতা দরকার ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। ধরা পড়ার পর মজনু পরিচয় অনেককে যেন হতাশই করেছে! এই ধর্ষক বাহিনীরও না, সরকারি দলেরওনা। জানা গেলো ছিনতাকারী মজনু একজন সিরিয়াল রেপিস্ট! বাড়ি নোয়াখালী। মূলত ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী নারীদের ধর্ষন করতো সে। এবং শিকারদের ধরে এনে সে ওই স্থানটাতেই ধর্ষন করতো! একজন সিরিয়াল ধর্ষক এভাবে রাজধানীর ব্যস্ততম রাস্তার পাশের এমন একটি ঝোপ এলাকাকে তার শিকারদের ধর্ষনের নিরাপদ হেরেম হিসাবে গড়ে নিয়েছিল! কিন্তু সেই যে বাঙালি প্রবাদ! বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান—! এই শিকার যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তা নিশ্চয় সে তা কল্পনায় ভাবতে পারেনি!
মঙ্গলবার রাতেই ধারনা পাওয়া যাচ্ছিলো ধর্ষক মজনুর গ্রেফতারের। কিন্তু তখনও তার নাম-সাকিন প্রকাশ করা হয়নি। বুধবার র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলন শুরু হয় নির্ধারিত সময়েরও বেশ পরে। দেশের বিদেশের এত মিডিয়া-এত ক্যামেরা! এমন জনাকীর্ন সংবাদ সম্মেলন মনে হয় অনেকদিন হয়নি বাংলাদেশে! অতঃপর ধর্ষক মজনুর বৃত্তান্ত জানাতে শুরু হয় সংবাদ সম্মেলন। পুরো ঘটনা শুনতে শুনতে প্রথম মনে হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রীকে মজনু প্রথম ছিনতাইর উদ্দেশে আক্রমন করেছিল! কিন্তু তার যে ধর্ষনের অভ্যাস! তখন সে পুরুষ আর তার শিকার একটি মেয়ে-একটি নারী। বাংলাদেশ শুধু না পৃথিবীর সব ধর্ষক যেন স্বাভাবিক ভাবে, নারী তার পদানত, তার ভোগের সামগ্রী! নোয়াখালী থেকে আসা মজনু, ট্রেন থেকে পড়ে দাঁত হারানো মজনু, সে ছিনতাই করে, নেশা করে, আর তার প্রিয় প্যাশন ধর্ষনের মাধ্যমে নারী দেহ উপভোগ করা! এখানে এক মজনু ধরা পড়েছে। এমন হাজার ধর্ষক মজনু আছে বাংলাদেশে।
এই চাল-চুলোহীন মজনুর বিচার হবে। কারন তাকে বাঁচাতে বড় পারিশ্রমিকের আইনজীবী পাশে দাঁড়াবেননা। আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমদের পক্ষে বড় পারিশ্রমিকের আইনজীবীরা দাঁড়ায় বলে বাংলার হাটেঘাটে ঘুরে বেড়ানো হাজারও ধর্ষকরা আস্কারা পায়। নারীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী পৃথিবীর সব ধর্ষক একেকটি মজনু। গরিব হওয়াতে সিরিয়াল ধর্ষক এক জায়গায় ফেসে গেলো। আপন জুয়েলার্সের সাফাতের মতো ধনী ধর্ষক হলে তাকে মানসিক রোগীর তকমা দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করতো বড় পারিশ্রমিকের আইনজীবী। বাংলাদেশে ধর্ষন বাড়ার বড় কারন বেপরোয়া পুরুষালি! এটি ছিনতাইকারী মজনু, আপন জুয়েলার্সের সাফাত আহমদ সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আন্দোলনের অভাবে সবক্ষেত্রে মজনুরাও এত দ্রুত ধরা পড়েনা। বাংলাদেশের বর্বর আইনে ধর্ষিতাকে প্রমান করতে হয় সে ধর্ষিতা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরীক্ষায় গিয়ে হয়রানির শিকার হয় ধর্ষিতা। বিচার না পেয়ে আত্মহত্যারও পথ বেছে নেয় অনেক ধর্ষিতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষন বিরোধী আন্দোলনকারীরা ধর্ষনের শিকার মেয়েটির ছদ্মনাম দিয়েছে সমাপ্তি। ধর্ষনের ঘটনার চির অবসানের আশায় এই নাম দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এক আন্দোলনেই ধর্ষন বন্ধ হবেনা। কারন এখানে একটি ছেলে, ছেলে হিসাবে একটি মেয়ে, মেয়ে হিসাবে বড় হয়। এমন একটি সমাজের সিংহভাগ ছেলেরা যে ধর্ষকামী তা যে কোন টিভি বা অনলাইনের লাইভ চ্যাটের অংশে ঢু মারলেই বোঝা যাবে। প্রায় প্রত্যেকের মন্তব্যে থাকবে , ‘তর—দি! এরা মজনুর মতো চালচুলোহীন নিরক্ষর নয়। উন্নত বিশ্বে এমন অনলাইনে যা খুশি লিখেবলে কারও পার পাবার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের বিমান বন্দর সড়কের ওই পথ শুধু নয় অনলাইন সহ কোন কিছুই নারীর জন্যে নিরাপদ নয়। নিরাপত্তার অনাস্থা থেকেই এবারের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আন্দোলনে সরকার যাতে বিব্রত না হয়ে সে চিন্তায় এবং প্রতিযোগিতায় সবার আগে মজনুকে ধরে প্রকাশ করেছে র‍্যাব। যেভাবেই হোক র‍্যাব চমৎকার পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। চমৎকার মানবিক আন্দোলনটি গড়ে তোলায় প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়েদের অনেক শুভেচ্ছা। ভিকটিম মেয়েটির, আমাদের বোনটির দৃঢ়তা প্রশংসনীয়। কিন্তু আমার এই বোনটির কী আর দিন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হবে? আমি সন্দিহান। কারন আমি আমার দেশ ও সমাজকে চিনিজানি।

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com