খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বিশেষ আবেদন!

খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বিশেষ আবেদন!

ফজলুল বারী:কোকোর মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কোকো জিয়া-খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় সন্তান। বিএনপির সর্বশেষ ক্ষমতায় থাকার সময় তারেক-কোকো, খালেদা জিয়ার ভাইয়েরা দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে বিশেষ একটি অবস্থার সৃষ্টি করাতে দেশে ১/১১ আসে। তাই শুধু খালেদা জিয়া নন, তারেক-কোকোও তখন গ্রেফতার হন। এরমধ্যে তারেকের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। কোকোর পুরনো স্বাসকষ্টের রোগ ছিল। সুযোগ পেয়ে তারেক কোকো দু’জনে শর্ত সাপেক্ষে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে তখন সপরিবারে বিদেশে চলে যান। ওই অবস্থায় বিদেশে মৃত্যু হয় কোকোর। তারেক আর দেশে ফেরেননি।

খালেদা জিয়ার দুই ছেলের এ বৃত্তান্তটি আজকাল খুব কম বলা হয়। হঠাৎ গল্পগুলো শুনলে অনেকের মনে হবে এই দুই ভাগ তখন বিদেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। হাওয়া ভবন নামেও দেশে কিছু ছিলোনা! সব মিডিয়ার সৃষ্টি! হাওয়া বিবির স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে দেখা হয়েছিল। তার স্ত্রীর নামে গড়া বাড়ির নামধরে বাংলাদেশে কেলেংকারির ঘটনায় তিনি বিব্রত ছিলেন। এরজন্যে বিএনপি পরে আর হাওয়া ভবনের পুনরুত্থান ঘটায়নি। বিএনপি নেতাদের ‘ফালু সাহেব’ খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিস-বাড়ি দুটিই নিজে পছন্দ করে সাজান। দুর্নীতির বরপুত্র সেই ‘ফালু সাহেব’ও আর দেশে নেই। ‘ফালু সাহেব’ এর টেলিভিশনে এখন সাংবাদিক ছাটাইয়ের মহোৎসব চলছে। কারও নজর সেদিকে নেই।

কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে সহানুভূতি জানাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি। কারন খালেদা তখন মনে করতেন যে কোন দিন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিয়ে তিনি আবার ক্ষমতায় বসে যাবেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের বাইরে দাঁড়ানো! আর বিএনপি গেটে তালা মেরে দিয়েছে! ভাবতে পারেন!  যেমন হেফাজত যখন মতিঝিলে তান্ডব করে তখনও হরতাল প্রত্যাহার করে সংলাপে বসতে ডেকেছিলেন। তখনও রাজি হননি খালেদা জিয়া। কারন তখনও তিনি ভাবছিলেন হেফাজত যখন মতিঝিলে আগুন দিয়েছে তখন সরকার পড়ে যাবেই! এভাবে খালেদা নিজেকে সব সময় সুপিরিয়র আর শেখ হাসিনাকে শুধু গোপালগঞ্জের গোপালিই ভেবেছেন। এরজন্যে তিনি এখন জেলখানায় আর শেখ হাসিনা ক্ষমতায়।

খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে আগেও লিখেছি। তিনি দুর্নীতির মামলার দন্ড নিয়ে কারাগারে আছেন। তাঁর এই দুর্নীতির অভিযোগটি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার সময়কার। এতিমখানা করার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে বিদেশ থেকে টাকা এসেছিল। প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলের একাউন্ট থেকে সেই টাকা চুপচাপ ব্যক্তিগত একাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয় এতিমখানার ঠিকানা হিসাবে। কিন্তু এতিমখানা আর করা হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও এই দুর্নীতির খবর পায়নি। কিন্তু সেনা গোয়েন্দা সংস্থা গোপন দুর্নীতির নথি তাদের সংগ্রহ করে তাদের কাছে নিয়ে রাখে। সেই নথি নিয়ে ১/১১ এর সময় মামলাটি হয়। এরজন্যে রাজনৈতিক কর্মীদের সব সময় বলি, সেনা গোয়েন্দা সংস্থা সব সময় কাজ করে শুধু সেনাবাহিনীর জন্যে। অন্য কারও জন্যে নয়।

খালেদা জিয়ার এই এতিমখানা দুর্নীতির মামলার অকাট্য প্রমানাদির কথা বিএনপির আইনজীবীরা জানতেন। সে কারনে এই মামলা দেরি করতে যা যা করতে হয় তাই তারা করেছেন। কতবার যে এই মামলা আর আদালতে অনাস্থা দেয়া হয়েছে! মামলার তারিখ দেখে দেয়া হয়েছে হরতাল! মনে করেছেন এরমাঝে সরকার পরিবর্তন হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের আশামতো সরকার পরিবর্তন হয়নি। সরকারও এই মামলা নিয়ে কখনও তাড়াহুড়া করেনি। মামলা নিজের মতো করে শেষ হয়েছে, সাজা নিয়ে কারাগারে গেছেন খালেদা জিয়া। আমরা ওই সময়ে ভেবেছি খালেদা জিয়াকে জেলখানায় নেবার ঘটনায় ঢাকায় এবং দেশে না জানি কী লংকাকান্ড ঘটে যায়! এই যে কিছুই ঘটেনি এরসঙ্গে দেশের মানুষের মনোযোগ বিবেচনা করে দেখুন।

রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাদের নেতাদের দুর্নীতি স্বীকার না করলেও দেশের মানুষ মনের দিক দিয়ে কোন দুর্নীতিবাজ পছন্দ করেনা। ওই সময় বিএনপি উল্টো জেলখানায় তাদের নেত্রীর আরাম আয়েশের দিকে মনোযোগ দেয়! তারা দাবি করে খালেদা জিয়ার গৃহপরিচারিকা ফাতেমাকে তাঁর সঙ্গে থাকতে দিতে হবে। এমন আবেদন এর আগে বিশ্বের কোথাও কেউ শোনেনি। কিন্তু সরকার বিস্ময়করভাবে তাতে রাজি হয়ে যায়। অতএব প্রথম থেকেই খালেদা জিয়া জেলখানায় তার ফাতেমার রান্না করা পছন্দের খাবার খাচ্ছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে শেখ হাসিনা মজা করে বলেন, চাইলে মেকআপের লোকও দেয়া হবে। কিন্তু জেলখানায় খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এর কারনও বিভিন্ন সময়ে লিখেছি।

খালেদা জিয়ার মূল সমস্যা আর্থাইটিজ এবং ডায়াবেটিকস। এ দুটি অসুখ মানুষের মানসিক অবস্থার সঙ্গে বাড়ে কমে। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক জিয়ার স্ত্রী ছিলেন। ফার্স্ট লেডি এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতা হারালেও বিলাসবহুল জীবন ছিল তার। ফিরোজায় থাকতেন। তাই তাকে বিশেষ কারাগার বা বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিভিআইপি স্যুট যেখানেই ফাতেমা সহ রাখুন না কেনো তারতো মন ভালো থাকেনা। তাই তার আর্থাইটিজের সমস্যা আরও বেড়েছে। এরমাঝে তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে সহায়তা করেননা। তার এখন পেইন কিলার, ইনজেকশন, ফিজিও থেরাপি ছাড়া আর কোন চিকিৎসা নেই। হাড়ের ওপর ইনজেকশন দিতে হয় বলে এই ইনজেকশন দেবার সময় প্রচন্ড ব্যথা করে। সে কারনে তিনি ইনজেকশন দিতে রাজি হননা। ডায়াবেটিকসে খাবার মেনে চলা, হাঁটাচলা গুরুত্বপূর্ন। যা খালেদা জিয়া অনুসরন করেননা। আপিল বিভাগে সর্বশেষ জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে বিএনপির আইনজীবীরা যে কান্ড করেছেন এতে করে তারা নিজেদের হাস্যষ্পদ করেছিলেন। এমন অবস্থায় সৃষ্টি করেছিলেন যে আজ শুনানি না হলে রাতের মধ্যে রোগী মারা যেতে পারেন!

সর্বশেষ কোকোর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্বজনদের দেখা করার পর বোন সেলিমা ইসলাম বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি উপলক্ষে বিশেষ আবেদনের কথা ভাবছে পরিবার। ‘বিশেষ আবেদন’ মানে হতে পারে প্যারোল। দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে হবে। প্যারোলে মুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেননা। এরজন্যে খালেদা এবং বিএনপি প্যারোলে মুক্তি চায়না। আর প্যারোল ছাড়া ‘বিশেষ আবেদনের’ কোন সূত্র নেই। এখন যদি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে খালেদা জিয়া বিদেশও চলে যান আর্থাইটিজ-ডায়াবেটিকসের আলাদা চিকিৎসা সেখানে কিছু নেই। কিন্তু মুক্ত পরিবেশে তার মন ভালো হবে বলে এ সমস্যাগুলোর অটোমেটিক উন্নতি হবে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার স্বার্থে এ নিয়ে তাদের জেদাজেদি করা ঠিক হবেনা।

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com