ফজলুল বারী: রাশিয়ার আক্রমন আগ্রাসন। ইউক্রেন যুদ্ধ। জেলেনস্কির নেতৃত্বে ইউক্রেনীয়দের অভাবিত প্রতিরোধ! এসবকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ সপ্তাহে বিশ্ব আরও বেশি করে আমেরিকা-রাশিয়া দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। ঐক্য শুধু এক জায়গায় আছে। মূল্যবৃদ্ধির ঐক্য। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি।
সিডনিতে যে তেল আমি প্রতি লিটার ১ ডলার ৪০-৪৫ সেন্টে কিনতাম, তা এখন প্রায় ২ ডলার লিটার! বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধির পোষ্টার হলো টিসিবির গাড়ির সামনের লম্বা লাইন! ‘কেউ যদি দেখে ফেলে আমার মান ইজ্জত ধুলায় মিশে মাটি হয়ে যাবে’ বলে অসহায় মধ্যবিত্তের মুখ লুকোনো!
তাদের আবার সারাক্ষন দেশের বেশি কথা বলা তথ্যমন্ত্রীর মান-ইজ্জতও রক্ষা করতে হয়! তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে! এরজন্যেও বর্ধিত মূল্যে জনগনের পকেট কাটায় সমর্থন দিচ্ছেন মন্ত্রী! একটা দেশের এমন মন্ত্রী বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!
বাংলাদেশের মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের মূল্যবৃদ্ধির জন্যে অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধও লাগেনা। যখন খুশি তারা দাম বাড়ায়। রোজার বহু আগেই রোজায় এবার দাম বাড়বেনা বলে তারা আগাম দাম বাড়িয়ে নেয়! ব্রাজিলের আবহাওয়া সংবাদ শুনে বা স্বপ্নে দেখে তারা বাড়িয়ে নেয় সয়াবিন তেলের দাম!
কৃষিমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হতে চান! তিনি আবার ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে বলেন, আহা ব্যবসায়ীদের মুখগুলো বড় শুকনো শুকনো লাগছে! সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধি না করলে মুখ শুকনো ব্যবসায়ীরা যদি অভিমানবশত তেল আমদানি না করে! আহা এমন ব্যবসায়ীবান্ধব কৃষিমন্ত্রী কোথায় কে দেখেছে?
ইউক্রেন আক্রমন করায় যুদ্ধবাজ আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলো নানান নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। এতে করে যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। উল্টো তাদের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে। আর বিশ্বজুড়ে বেড়েছে ভোগ্যপণ্যের মূল্য। খাবার সহ ভোগ্য পণ্যের মূল্যবৃ্দ্ধিতে অতিষ্ঠ গোটার বিশ্বের আমজনতা।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউরোপ সফর করে গেছেন। ন্যাটো দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্রাসেলসে। পোলান্ডে গিয়ে কথা বলেছেন শরণার্থীদের সঙ্গে। এই সময়ে বাইডেনের সাফল্য তার পিছনে উন্নত বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু কোন কিছুতে বেশি খুশি হওয়াও এক ধরনের সমস্যা।
পোলান্ড এসে বাইডেন বলেছেন, ক্রেমলিনের ক্ষমতা থেকে পুতিনকে সরাতে হবে। সে একটা কসাই। সে আর রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকতে পারেনা। আমেরিকা সাধারনত কাউকে ক্ষমতা থেকে সরাতে নানা বাহানায় সে দেশে গিয়ে আক্রমন করে। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ায় গাদ্দাফির বেলায় তা করেছে।
কিন্তু পরমানু শক্তিধর রাশিয়ার বেলায় আমেরিকা সে সাহস করেনি। রাশিয়ার ক্ষমতা বদলে বাইডেনের বক্তব্যে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বলেন আমরা যুদ্ধ বন্ধ করতে চাই। এ ধরনের কথাবার্তায় পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করতে চাইনা।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যেকে কান্ডজ্ঞানহীন উল্লেখ করে ক্রেমলিন থেকে বলা হয়, রাশিয়ার ক্ষমতায় কে থাকবেন না থাকবেন, এটা ঠিক করবেন রাশিয়ার জনগন। জো বাইডেন নন। ওয়াশিংটনের ক্ষমতায় আসার পর বাইডেন এই প্রথম মুখের ওপর এমন শক্ত বিরোধিতা দেখলেন।
আমেরিকা অবশ্য পরে পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার বক্তব্য থেকে সরে আসে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন ইসরাইল সফরকালীন মিডিয়া ব্রিফিঙে বলেন, আমেরিকা ক্রেমলিন বা বিশ্বের কোথাও ক্ষমতার পালাবদলের কাজ করেনা। আমেরিকা আসলে কোথায় কি কাজ করে তা বিশ্ব জানে।
এক সময় সিআইএ পোলান্ড থেকে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটানো শুরু করেছিল। লেচ ওয়ালেসার কথা মনে আছে নিশ্চয়। রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে পোলিশ এই টেড ইউনিয়ন নেতার নেতৃত্বে আন্দোলনের সাফল্যের পর একে একে খসে পড়তে থাকে লাল দূর্গ।
আমাদের সীমান্তের পাশে তখনও লালঝান্ডা উড়তো পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়। তারাও আর নেই। জ্যোতি বসু নেই। নৃপেন চক্রবর্তী নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা মাঠ গরম করতে পেরেছিল। এখন সমাজতন্ত্রী, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী উভয়পক্ষ শীর্ণকায়।
অতঃপর সমাজতন্ত্র শব্দটি শোপিস হিসাবে আওয়ামী লীগের সংবিধানে সযত্মে তুলে রাখা হয়েছে। একদিন প্রিয় প্রজন্ম প্রশ্ন করলে সমাজতন্ত্র শব্দটি শোপিস হিসাবে রাখার কারন জানতে পারবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘের ভেটো শক্তি সম্পন্ন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন পক্ষে ছিল।
এর কৃতজ্ঞতা হিসাবে সংবিধানের চার মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র শব্দটি রাখা হলেও একমাত্র তাজউদ্দিন আহমদ ছাড়া এর নেতারা এই দর্শনে বিশ্বাস করতেননা। মুক্তিযুদ্ধের পর অবশ্য সমাজতন্ত্র শব্দটিকে দেখিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ডুবন্ত জাহাজ অপসারনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা নেয়া হয়।
নেতারা ফ্রি চিকিৎসার জন্যে মস্কো সফরে যেতেন। এদেশে উদয়ন’, সোভিয়েত নারী এসব পত্রিকা ফ্রি এলে তা বইয়ের কভার লাগানোয় ব্যাপক ব্যবহার হতো। এখন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়াও নেই। সমাজতান্ত্রিক দেশও নেই। এরপরও কিছু লোক মাঝে মুক্তিযুদ্ধের বাহাত্তরের সংবিধান ‘ফেরত চাহিয়া’ প্রায় চিৎকার করে।
তাদের চিৎকার বন্ধে ‘সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধর্ম নিরপেক্ষতা’ শব্দটিও সংবিধানে শোপিসের মতো করে রেখে দেয়া হয়েছে! যদিও এই আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী ধর্ম নিরপেক্ষতায়ও বিশ্বাস করেনা। মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রগতিশীল সাজতে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা পোষ্টে লিখলেও পরে মনে মনে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ বলিয়া নেয়’!