ফজলুল বারী:পত্রিকায় প্রথমে শিরোনামটি পড়ে চমকে উঠেছি। ‘নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোন জাতিকে নিয়ন্ত্রন করা যায়না’। সঙ্গে শেখ হাসিনার ছবি। মানবজমিনে শিরোনামটি পড়ে ভাবলাম, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে শিরোনাম কিনা! চলতি নিষেধাজ্ঞায় দেশের যে সব মিডিয়া খুশি, মানবজমিন এর অন্যতম।
দেশে–বিদেশে কেউ যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, আওয়ামী লীগ সরকার বা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যদি একটা লাইন বা শব্দও বলে তাতেই যেন আনন্দের সীমা নেই! আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা কেনো বাংলাদেশের ক্ষমতায় এ নিয়ে আক্ষেপ–অসন্তোষের শেষ নেই! আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
রিপোর্টের ভিতরে গিয়েও চমকে যেতে হয়। বলা হয় শেখ হাসিনার মুখে কিছু আটকায়না! অথবা এভাবে বোল্ডলি বুঝি শেখ হাসিনার পক্ষেই বলা সম্ভব। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা–যুদ্ধের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অষ্টমতলা ভবন ভার্চুয়ালি উদ্বোধনের সময় দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী কথাগুলো বলেন।
কথায় বলে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে উলুখাগড়ার প্রান যায়! শেখ হাসিনার বক্তব্যে এই ক্ষেদোক্তিই প্রকাশ পেয়েছে। আমেরিকা–রাশিয়া দুজনে দুজনার জানি দুশমন। সব সময় যুদ্ধ করে, দুনিয়ার নানা দেশে গিয়ে হামলা করে, সামরিক অভিযান চালায় আমেরিকা। সেগুলো তারা বিশ্ব শান্তি(!)র জন্যে করে!
এবার রাশিয়া তথা ভ্লাদিমির পুতিন একটা মহা বেয়াদবি করে ফেলেছে! হামলা করেছে ইউক্রেনে। সেখানে রাশিয়ার সামরিক অভিযান কোন শান্তিপ্রিয় মানুষ সমর্থন করবেনা। কিন্তু রাশিয়াকে শাস্তি দিতে গিয়ে মার্কিন নানা নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের মতো দেশ যে শাস্তি পাচ্ছে এর প্রতিকার কী?
এতে আমেরিকার কোন ক্ষতি নেই বরং লাভই হচ্ছে। দুনিয়ার যেখানেই যুদ্ধ হোক না কেনো আমেরিকা সেখানে অস্ত্র বিক্রি করতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেদারসে অস্ত্র বিক্রি করছে আমেরিকা এবং এর মিত্র বিভিন্ন দেশ। ইউক্রেন অস্ত্র যা যা চাচ্ছে সবই তাকে দেয়া হচ্ছে।
এভাবে যুদ্ধকে জিইয়ে রেখেছে ন্যাটোভূক্ত সব দেশ। আক্রান্ত ইউক্রেনের শরণার্থীদের আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো প্রতিযোগিতা করে আশ্রয় দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে। এভাবে মানবিক একটি বিপর্যয় সামাল দেয়া হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী একজনও নিতে তাদের রাজি করানো যায়নি।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জ্বালানি খাত। তেল–গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজার–সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাশিয়ার জোগানের ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় তেল–গ্যাসের বাজারে এখন অগ্নিমূল্য। রাশিয়া কমদামে ভারত–চীনের মতো দেশের কাছে তেল–এলপিজি গ্যাস বিক্রি করছে।
এসব দেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে থোড়াই কেয়ার করে। এক–দু’বার ভারত–চীনের নেতৃত্বকে এ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সরাসরি কথা বলে হুমকি দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তারা সে হুমকিকে গায়ে মাখেনি। বাংলাদেশের মতো দেশ সাহস করে সস্তায় রাশিয়ান তেল–গ্যাস কিনতে পেরে সমস্যায় পড়েছে।
যে তেল আগে ব্যারোল প্রতি ষাট–সত্তুর ডলারে কেনা যেত সেটি এখন একশ সত্তুর ডলারেও কেনা যাচ্ছেনা। বাংলাদেশ দেশের বাজারে ভর্তুকি দিয়ে তেল–গ্যাস বিক্রি করে জনগনের কাছে হিরো সেজে থাকতে চায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের দুর্মূল্য নিয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে সরকার।
রাশিয়া–ইউক্রেন পৃথিবীর অন্যতম শস্য ভান্ডার। গম–সূর্যমুখি তেল সহ নানান খাদ্য পণ্যের বড় যোগানদার এই দুই দেশ। যুদ্ধের কারনে সেখানকার সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় বিশ্বের অনেক দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গম বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য না হলেও বিস্কুট–রুটি শিল্পের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ।
পোলট্রি সহ পশু–পাখি খামারীদের মাথায় হাত পড়েছে গমের বাজারে আগুন প্রবাহে। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশ গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুতের দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গ্যাস মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারনে দুর্মূল্য হওয়াতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লোডশেডিং ফিরে এসেছে দেশে।
এমন নানাকিছুতে বিক্ষুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক রকম বিস্ফোরিত হয়েই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন। বাংলাদেশ সার কিনতো রাশিয়া থেকে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারনে রাশিয়া থেকে সার কিনতে না পেরে কয়েকগুন বেশি দামে কানাডা থেকে সার কিনছে।
কানাডাও রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া অন্যতম দেশ। কিন্তু এতেতো তাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। বাংলাদেশের মতো দেশের কাছে বেশি দামে তারা সার বিক্রি করতে পারছে। নিষেধাজ্ঞাও এদের কাছে এক রকম বানিজ্যের নাম। এরজন্যে বাংলাদেশের মতো দেশ সাফার করবে কেনো?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টিকে বাংলাদেশের মতো দেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘন বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় কষ্টে থাকা আর কোন দেশের রাষ্ট্রপতি–প্রধানমন্ত্রী এমন সাহস করে বক্তব্য দিয়েছেন? শেখ হাসিনার মতো কথা বলার সাহস আর কয়জনার আছে?
এই সুযোগে শেখ হাসিনা কী পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা নিয়েও আমেরিকাকে কী এক হাত নিলেন? হতেও পারে। ঢাকার নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস একটু বেশি ঘোরাঘুরি করছেন, কথা বলছেন! পিটার হাস কী বাংলাদেশের নেতৃত্বকে উত্তেজিত করার অপচেষ্টা করছেন?
হতেও পারে। তাদের আওয়াজ দিতে হবে। হয়তো শেখ হাসিনা এই সুযোগে দিয়েছেনও। কিন্তু তাদের ফাঁদে পা দেয়া যাবেনা। বাংলাদেশ নিজের সমস্যা নিজে দেখবে। পিটার হাসদের মাতব্বরি অনুমোদন করে নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করতে কোয়াড গঠন করেছে।
কোয়াডে তারা বাংলাদেশকে নিতে চাচ্ছে। ভারতও তাই চায়। চীনের সঙ্গে ভারতের সমস্যা আছে। ভারত কোয়াড–টোয়াডে যাক। গলা ভর্তি করে আমেরিকার সঙ্গে মদ খাক। বাংলাদেশকে নিয়ে টানাটানি করার দরকার নেই। অনেকে বলতে পারেন শেখ হাসিনার এভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলার দরকার ছিলোনা।
আমেরিকা এর শোধ নিতে পারে। ঘোড়ার ডিম করবে আমেরিকা। এরা হলো গিয়ে শক্তের ভক্ত নরমের যম। শেখ হাসিনা যে কথাগুলো বলা শুরু করে দিলেন তা এখন অনেকে বলবে। আমেরিকা–রাশিয়ার টাগ অব ওয়ারের শিকার কেনো বাংলাদেশের মতো দেশ হবে? অভিনন্দন শেখ হাসিনা।