ফজলুল বারী:একটি চিঠি নিয়ে অনলাইন এখন গরম! অনেক পত্রিকা এ নিয়ে রিপোর্টও করেছে। এসব রিপোর্টে বলা হয়েছে কয়েকজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে চিঠি লিখেছেন! এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শেখ হাসিনার সরকার খুব খারাপ! এই সরকারকে সাইজ করে দিন!
সাইজ কি করতে হবে সেটাও বলে দেয়া হয়েছে চিঠিতে! জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বের করে দিতে হবে! জাতিসংঘ বাহিনীতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশের সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে জাতিসংঘ। বহুবছর ধরে তারা সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
আর তাদেরকে বের করে দেবেন জাতিসংঘের মহাসচিব নন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন! এই চিঠিটি সবার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন বিএনপির নেত্রী শ্যামা ওবায়েদ! তিনি এখন দলের আন্তর্জাতিক বিষয়াদি দেখেন! এক সময় এ দলের আন্তর্জাতিক বিষয়াদি দেখতেন শমশের মোবিন চৌধুরীর মতো পেশাদার সাবেক কূটনীতিক।
তা এখন শ্যামা ওবায়েদ পর্যায়ে পৌঁছেছে! খালেদা জিয়াকে একবার কম্পিউটারের মাউস ধরতে শেখানোর তার একটি ছবি একবার ভাইরাল হয়েছিল। তিনি কোন উদ্দেশে সবার আগে এটি শেয়ার করেছেন, সে বিষয়টি পরে আসছি। আগে নতুন প্রজন্মকে শ্যামা ওবায়েদ প্রসঙ্গে জানাতে হয়। ইনি এক সময়কার বিএনপির মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে। কে এম ওবায়দুর রহমান এক সময় ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগের যে সব বিশ্বাসঘাতক খুনি মোশতাকের সঙ্গে হাত মেলান, ওবায়দুর রহমান ছিলেন তাদের অন্যতম। পরে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগ দিয়ে তিনি বিএনপির মহাসচিব হন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তিনি টিকতে পারেননি।
সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি গঠন করেন নিজস্ব রাজনৈতিক বিএনপি-ওবায়েদ। তার মৃত্যুর পর শ্যামা ওবায়েদের মা শাহেদা ওবায়েদ বিএনপির এই খন্ডের প্রধান হন। তারেক রহমানকে তিনি একবার বলেছিলেন বিশ্ব বেয়াদব। মা-মেয়ের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। শ্যামা চলে যান খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের কাছে।
এখন মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের কথিত চিঠি সবার আগে শ্যামা ওবায়েদ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করায় অনেকের ধারনা বিএনপি লবিষ্টদের ফল। গত ১৪ বছর ধরে বিএনপি-জামায়াত বিদেশে লবিষ্ট ফার্মের মাধ্যমে এমন অনেক চিঠির ব্যবস্থা করেছে। এরজন্যে দলটিকে লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয় করতে হয়।
খালেদা জিয়ার নামে মার্কিন পত্রিকায় নিবন্ধও ছাপা হয়েছে যাতে আবেদন করা হয়েছে বাংলাদেশকে যাতে কোন সাহায্য দেয়া না হয়। মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা লবিষ্ট ফার্মের মাধ্যমে অর্থ প্রাপ্ত হয়ে এমন অনেকে চিঠি লিখেন। এ নিয়ে মজা করে বলা হয়, ‘নাথিং ইজ ফ্রি’।
এ সব চিঠি নিয়ে যাদের আগ্রহ তাদেরকে বিশেষ করে ডক্টর ইউনুসের পক্ষে মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের একটা চিঠির বিষয়ে মনে করিয়ে দেই। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন চালু হয় ১৯৯৯-৯৬’র বিএনপির আমলে। সিটি সেল নামের ওই মোবাইল ফোন কোম্পানির মালিক ছিলেন বিএনপি নেতা মোর্শেদ খান।
বিএনপির এই নেতাকে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ করে দিতে তখন আর কোন কোম্পানিকে মোবাইল ফোন চালুর লাইসেন্স দেয়া হয়নি। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যা জানেননা তাহলো তখন মোবাইল ফোনে ইন কামিং কল চার্জও ছিল। মানে আপনার ফোনে কেউ কল করলে এরজন্যেও আপনাকে টাকা দিতে হতো। এরজন্যে মোবাইল ফোন তখন আজকের মতো সবার ব্যবহারের জন্যে ছিল না। বাংলাদেশের মোবাল ফোন ছিল ধনী-বড়লোকদের বিষয়!
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে গ্রামীনফোন সহ আরও কিছু কোম্পানিকে মোবাইল ফোন বাজারজাত করার লাইসেন্স দেয়। গ্রামীনফোনও বাজারে এসে ইনকামিং কল চালু রাখে! মোহাম্মদ নাসিম তখন টেলিফোন মন্ত্রী। সরকারের সিদ্ধান্তে মোবাইল ফোনের ইনকামিং চার্জ নিষিদ্ধ করা হয়।
এতে ক্ষিপ্ত হন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি কয়েকজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে শাসানি দিতে চিঠি লেখান। এসব চিঠির ভাষা আবার ভদ্র হয়! ওই কংগ্রেসম্যনরা শেখ হাসিনাকে লিখেন, ডক্টর ইউনুস তাদের ঘনিষ্ঠ। তাকে যেন দেখে রাখা হয়। শেখ হাসিনা ওই চিঠিকে আমলে নেননি।
গ্রামীন ফোন সহ মোবাইল ফোনের ইনকামিং চার্জ নিষিদ্ধ থাকে। কাজেই ডক্টর ইউনুস যে আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার ওপর ক্ষিপ্ত তা আজকের বিষয় নয়। মার্কিন একটি ফোনের ঘটনা এই সুযোগে বলে নেই। এখন গনতন্ত্রের কান্ডারী জি এম কাদেরের বড় ভাই জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর এমএলআর-৮২ নামের এক আইন জারি করেছিলেন।
এমএলআর-৮২ মানে এরশাদের সামরিক শাসনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিরোধিতা করলেই সাত বছরের জেল! তখন ডক্টর কামাল হোসেন সহ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ডক্টর কামাল তখন আওয়ামী লীগ করতেন। ডক্টর কামালের গ্রেফতারের খবর শুনে ফোন করেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।
এরশাদের অফিসে ফোন করে হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, শুনলাম ডক্টর কামালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি আমাদের লোক। তার শরীর এখন কেমন আছে? হেনরি কিসিঞ্জারের ফোনের খবর শুনে কাঁপতে শুরু করে দেয় জেনারেল এরশাদের সামরিক সচিবালয়! ডক্টর কামাল হোসেনকে সেদিনই মুক্তি দেয়া হয়।
আমরা তখন একই আইনে সিলেট কারাগারে বন্দী। জেলখানায় বসে রেডিওতে ডক্টর কামালের মুক্তির খবর শুনে আমরা ভাবলাম আমাদের কি আর আটকে রাখবে এরশাদ! পরের দিন আমাদেরও জামিনে মুক্তি হয়ে যায়। এখানেই এরশাদ আর শেখ হাসিনার পার্থক্য! এসব মার্কিন ফোন-কংগ্রেসম্যানদের চিঠিকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। সে রকম ফাউল কাজ তিনি করেনওনা।
আলোচিত ১/১১’র আগে বাংলাদেশের মিডিয়ায় একটি খবর চাউর হয়। জাতিসংঘ বাহিনী থেকে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী-পুলিশের সদস্যদের প্রত্যাহারের হুমকি। ওই চিঠির পর দায়িত্বশীলদের পাতলা পায়খানা শুরু হয়। পরে জানা যায় সেটি ছিল একটি ভূয়া চিঠি।
শেখ হাসিনা যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন, তখন বিএনপি বলে বেড়ায় তারাও বিচার চায়, তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ আর আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন! তখন জামায়াত লবিষ্ট ফার্মের মাধ্যমে এমন কংগ্রেসম্যানদের চিঠি আনছিল অবিরাম! যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ফাঁসি শেখ হাসিনাকে ফোনও করানো হয়। শেখ হাসিনা বিষয়টি আমলে নেননি। দেশের সব শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে। বিএনপি আর স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন বিচারের কথা ভুলেও বলেনা।
কাজেই এসব চিঠি মানে কোরান বা বাইবেল নয়। অসৎ কংগ্রেসম্যানরা টাকার বিনিময়ে এসব চিঠি লিখে থাকেন। আপনি টাকায় আপনার পক্ষেও একটির ব্যবস্থা করাতে পারবেন। এরশাদের মতো জনবিচ্ছিন্নরা এসব চিঠিকে গুরুত্ব দিতেন। সেটা শেখ হাসিনা নয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আমেরিকা নিন্দা জানায়নি। খুনিদের নিষেধাজ্ঞাও দেয়নি। উল্টো খুনিদের সমর্থন দিয়েছে। এই প্রজন্ম সেই সমর্থনের ভাষা জানেনা। একেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর সামরিক সরকারকে স্বীকৃতির নামে সমর্থন দেয়া হতো! এখনও জাতির পিতার খুনি বাস করে আমেরিকায়। তাকে রক্ষাকবজ দিয়ে চলেছে আমেরিকা!
একাত্তরে জনতার ম্যান্ডেট পাওয়া আওয়ামী লীগকে শাসনদন্ড না এরাই জেনারেল ইয়াহিয়ার পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এরাই এখন বিশ্বের দেশে-দেশে তাদের মতো করে গনতন্ত্রের ধব্জাধারী! এদের মুখের ওপর উচিত কথা বলে দিতে শেখ হাসিনার মতো সাহসী নেতা এখন বিশ্বে খুব বেশি নেই। টাকায় লেখা কংগ্রেসম্যানদের চিঠি গোনার টাইমও নেই তার।