প্রবাসীর চোখে বাংলাদেশ ২০১৯  – শেষ পর্ব   

প্রবাসীর চোখে বাংলাদেশ ২০১৯  – শেষ পর্ব   

৭ জানুয়ারী ১৯ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯পাঁচ সপ্তাহঘুরে এলাম বাংলাদেশ। সিডনী বাঙালি পাঠকদের সাথে শেয়ার করছিলাম সেই সফরের অল্প বিস্তর আমার একান্ত কিছু অভিজ্ঞতা এবং অনুভব এই সময়ের বাংলাদেশকে ঘিরে।   

তিন পর্ব লেখার পর আজকের পর্ব দিয়ে শেষ করবো। লেখার শুরুতেই বলে নেই, মনের মাঝে থাকা একটা খচখচ বিষয়, এই লেখাটা নিয়েই। প্রথম দুটো পর্ব নিয়ে পাঠকদের কেউ কেউ একাত্ন হয়ে অনেক বিষয় শেয়ার করেছেন এবং ব্যাক্তিগতভাবে ভালোলাগা জানিয়েছেন। তৃতীয় পর্বটি লিখেছিলাম মূলত অনেককিছু বদলে যাওয়া ঢাকা শহর এবং এর সবচেয়ে বড় অভিশাপ ঢাকার যানজট নিয়ে।  

যানজটের বিরক্তির জন্যেই হোক বা আমার লেখার স্টাইলের জন্যেই হোক একজন পাঠক তাঁর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, বলেছেন এইসব ‘’হুদাই’’ লেখার কোন মানে হয়না। বলতে দ্বিধা নেই, মন খারাপ হলেও আমি আমার লেখার সমালোচনা মাথা পেতে এবং মন খুলেই মেনে নেই। কারণ আমি বিশ্বাস করি, অন্য অনেকের অনেক কাজ আছে, ভালো লাগা মন্দ লাগা আছে, আছে জীবনে মূল কোন ভালো পেশা বা অন্য কোন ইনভলভমেন্ট।  আমার আসলে অন্য কী আছে তা নিয়ে বলার কিছুই নেই এই মুহূর্তে জীবনে। টুকিটাকি লিখি, আর এই লেখাকে ঘিরেই আমি ও আমার বেঁচে থাকা…  

লেখা পড়ে কারো উপকার না হলেও অপকার হয়তো হয়না। কিন্ত লেখালিখির জন্যেই আমি এইটুকুন জীবনে অনেক পরিচিত এবং অপরিচিত মানুষের অসম্ভব ভালোবাসা পেয়েছি। লেখা হয়তো একশ মানুষ পড়ে, কিন্তু ভালো লাগা মন্দ লাগা জানায় হয়তো দশ জন, সেই দশ জন মানুষই আমার রীতিমত কাছের মানুষ হয়ে উঠে।  

বাংলাদেশ সফর নিয়ে কেন বলছি, আত্নপক্ষ সমর্থনে ছোট করে হলেও আজ বলেই নিতে চাই। আমি আসলে কোন চাওয়া নিয়ে এই লেখাটা শুরু করিনি। তবে শুরু করার পর মনে হচ্ছিলো, বাংলাদেশে অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রতি বছর যেতে পারেন না। বড় পরিবার যাঁদের তাদের এমন অনেকেই আছেন পুরো পরিবার হয়তো বাংলাদেশে যেতে পারে প্রায় ৩/৪ বছরে একবার। আমি এমন অনেককেই জানি, নানান জটিলতায় প্রায় অর্ধযুগেরও বেশী সময় ধরে যেতে পারেননা বাংলাদেশে। দেশে মা বাবা আত্নীয় স্বজনদের অনেকেই এর মাঝেই কেউ কেউ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। পাসপোর্ট, রেসিডেন্সি বা নাগরিকত্ব পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নানান অনিশ্চয়তায় এই যাই যাই করে যেতেই পারছেননা!!!  

আমি লিখতে গিয়ে, আসলে আমার একান্ত কথণেই অনেকদিন বাংলাদেশে যাননি বা অনেক কম যান এমন মানুষগুলোর আবেগকে ছুঁয়ে দিতে চাইছিলাম।চেয়েছি পড়তে যেয়ে কেউ কেউ নস্টালজিক হোক উন্নয়নশীল দেশের যে সমস্যাগুলো নিয়ে বাংলাদেশ আছে ভীষণ রকমের হুমকির মাঝে তারই একটা ঢাকার জ্যাম নিয়ে বলাটায় আসলে কোন বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়ার আমি কেউ নই কিন্তু যাঁদের এই নিয়ে ভাবনার সুযোগ আছে, কাজ করার সুযোগ আছে এই রকম একটা বাস্তবিক না হলেও মনের গভীর লুকানো একটা ইচ্ছে থেকেই আমি আমার মত করেই সমস্যাটা নিয়ে বলতে চাইছিলাম। আর কিছু না, কারো কাছে ‘’হুদাই’’ মনে হতে পারে চরম বিরক্তিতে, তাঁর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, কেউ কেউ এমন ‘’হুদাই কাজ’’ ছাড়া হয়তো কিছুই করতে পারেনা, তবুও করে, আমি সেই দলে!!!  

দুইটা বিষয় দিয়ে আজ শেষ করি,  ২০১৬তে বাংলাদেশ গিয়েছি। ঢাকায় গ্রীনরোডে উঠেছি, শ্বশুর বাড়ী। ও বাসায় থাকে যে মেয়েটা রান্নাবান্না ঘরের কাজের জন্যে, মর্জিনা ওর নাম। মোটামুটি রাত ১/১টার  মাঝে সব কাজ শেষ করে ঘুমাতে চলে যায়। ড্রুইং রুমের পাশের রুমেই সে ঘুমায়… আমি সাউন্ড লেস করে টিভি দেখি আর বই টই পড়ি রাত জেগে। এর মাঝেই এক রাত, প্রায় ১টা, মর্জিনার ফোন বেজে উঠে। আচমকা আওয়াজে আমি নিজেও চমকে যাই। ও ঘুম থেকে উঠে বসে কথা বলতে থাকে…  ওপাশের কথা না শুনেই বুঝতে পারি, কোন মৃত্যু সংবাদ। ও ফোন রাখার পর আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস পাইনা… ভাবছি ওকে কী সকালেই ওর গ্রামের বাড়ী যেতে হয় কিনা!!!  

তারপরও জানতে চাই, মর্জিনা সব ঠিক আছে? ও ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে আমাকে যে মৃত্যু সংবাদটি দেয়, সেটি ওর টাকায় কেনা গরুর বাছুরের। স্বাভাবিকভাবেই আমার শোক এবং শক মাত্রার পারদ নীচের দিকে নেমে আসে। আমার প্রচন্ড সংবেদনশীল মন দিয়ে হলেও ওর কষ্টটা বুঝার চেষ্টা করছিলাম তবে সাথে সাথে এ বুঝতে পারছিলাম এই শোক কাটানো সম্ভব… ওকে কিছু বাড়তি টাকা দিতে পারলেই। সেই সান্ত্বনা দিয়েই ওকে ঘুমাতে পাঠালাম এবং সেবারই প্রথম মানে আমার ২০০৯ এ বাংলাদেশ ছেড়ে আসার পর ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপান্তরিত হওয়ার একটা প্রত্যক্ষ রুপ যেন দেখে এলাম। বিশেষ করে হাতে হাতে মোবাইল ফোনের প্রভাব…  

 ২০১৯ এ এখন গোটা বাংলাদেশে এই ডিজিটালের অসংখ্য বহুমুখী ব্যাবহার এবং উপযোগিতা রীতিমত চোখে পড়ার মত। নিঃসন্দেহে সুপ্রভাব এবং কুপ্রভাব নিয়ে বিতর্ক টানা যেতেই পারে। তবে আমি অন্যরকম একটা বিষয় বলবো…  

ছোট বড় ব্যাবসাবাণিজ্যব্যাংকিংপড়ালেখাকমিউনিকেশনফটোগ্রাফি,  মোট কথা নেটওয়ার্কিং  এই সময়ের ডিজিটাল বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে অনেক বেশী শক্তিশালীযে বা যারা কাজে লাগাচ্ছেগ্লোবাল কমিউিকেশন কাজে লাগাতে পারছে সেই রকম একটা শ্রেণী বাংলাদেশে আছে। যার অনেক কিছু নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি, এবং মিডিয়া মারফতে নানানভাবে মাঝে মাঝে উঠে আসে আমাদের কাছে এমন সাফল্যগাঁথা, গৌরবগাঁথা। 

তবে প্রদীপের নীচে অন্ধকার যেমন থাকে। আমার মনে হচ্ছে আজকের বাংলাদেশে নীতি নৈতিকতার যে চরম অবক্ষয়ের কিছু চিত্র উঠে আসে তা নিয়ে আমার ব্যাক্তিগত একটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে নেট প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার একটি অন্যতম কারণ হতে পারে প্রকৃত শিক্ষা না থাকায় এই ব্যাবহার হয়ে উঠছে ভয়াবহ।  বিশেষ করে কিশোর অপরাধ, নারী কন্যা শিশুদের উপর যৌন হয়রানি এবং নির্যাতনের ধরণ এতো বেশী নির্মম এবং অভিনব হয়ে আমাদের সামনে আসছে বলেই আমার এমন ভাবনার অবতারণা।  

একদিকে ধর্মীয় কঠিন অনুশাসনের বাংলাদেশ অন্যদিকে আমাদের অজান্তেই কিশোর যুবা এবং যেকোন মানুষের হাতেই ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের সহজলভ্যতায় পর্ণোগ্রাফী এবং নানান রকমের আপত্তিকর ইউটিউব ভিডিও। সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করার কোন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগ না থাকায় এই রকম একটি স্পর্শকাতর বিষয় আমাদের এই মুহূর্তে অনেকটাই লাগামহীন এই বাংলাদেশে।  

আগের লেখাগুলোয় বলেছি, ২০০৯ এ দেশ ছেড়ে এই পরবাস জীবন বেঁছে নিয়েছি। আমার দেখা সেই বাংলাদেশ এবং এই ২০১৯ এর বাংলাদেশ আমুল বদলে গেছে। বিশেষ করে ধর্ম চর্চা সকল ধর্মের মানুষের মাঝেই চোখে পড়ার মতোন বেড়ে গেছে। ফেসবুকে এমন কোন ধর্ম নেই যাদের অনুসারীরা প্রচার প্রচারণায় নেই।  আমি যতদূর মনে করতে পারি, দেশে পিস টিভি চ্যানেল, ধর্মীয় বক্তা জাকির নায়েক এবং জামাত নেতা সাঈদীর ওয়াজ সহ অনেক আজে বাজে ওয়াজ অনেক ধর্মপ্রাণ কোমল মানুষকে ব্যাপক মোটিভেট করেছে গত এই এক দশকেই।  

আমাদের অনেকে যেমন সহজ সরল স্বাভাবিক ভাবে ধর্ম চর্চা করতো এখন তা নেই। প্রায় সকল মানুষের কথা বার্তা আচার আচরণ থেকে তাদের নাম এবং অন্যান্য সকল নামকরণে এসেছে তার প্রভাব। এসেছে নিষেধাজ্ঞা, এভাবে এটা বলা যাবেনা, এটা করা যাবেনা, পা ছুঁয়ে সালাম করা যাবেনা, শবেবরাত পালন করা যাবে, যাবেনা… রুটি হালুয়া বানানো যাবে, যাবেনা।  

ধর্মচর্চা অনেক বেশী বাড়লেও কমেনি একটুও মানুষের অসততা, অসভ্যতা। তবে সবচেয়ে চোখে পড়ার মত যেটা, মানুষের কনফিউশন বা স্ববিরোধিতা। শপিং মলে হাঁটতে যেয়ে যত্রতত্র দেখা যাবে ভীষণ ধর্মীয় পোশাক পরা কোন মায়ের সাথে হয়তো তার কিশোরী মেয়ে অনেক বেশীর রকমের উৎকট পাশ্চাত্য কোন ড্রেস পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ আজ এই বিষয়টি অনেক বেশী পরিষ্কার নিজের ধর্ম পরিচয় সবার আগে  এবং এটা বজায় রেখে সাংঘর্ষিক হলেও সব করা যাবে।  

একদিন স্বল্প পরিচিত এক প্রতিবেশীর বাসায় গিয়েছি। ও বাসার একটা ছেলে বিয়ে করেছে অতি সম্প্রতি। ওই ছেলের মায়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল একবার, আন্টি বলে ডেকেছিলাম, ভাবলাম নুতন বউকে হ্যালো বলে আসি। অস্ট্রেলিয়া থেকে গিয়েছি, তারপরও যা হয়, আমি সেই আমলেই পরে আছি, গুরুজন দেখলেই পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলতে নেই… ভুলেই হয়তো অনেক সময়। উনি আঁতকে উঠে আমাকে সামাল দেন… চা নাস্তা খেতে দেন আদর করে। কথা প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পারিবারিক মূল্যবোধ যাঁদের আছে বা কতোটা স্ট্রং বা কিভাবে মেইনটেইন করে তাই বলছিলাম…  আমার মতোন করেই। আমি যখন কথা প্রসঙ্গে বলছিলাম, এখানকার বাচ্চারা ছোট বেলা বা বড় বেলা মা-বাবাকে হাগ দেয় অনেক বেশী, আলিঙ্গন করে এবং বিশেষ দিনগুলোতে কিভাবে সেলেব্রেট করে… উনি আমার কথা শুনে আবারো এমন এক প্রতিক্রিয়া দিলেন আমি আসলে অনেকটাই স্পিচলেস হয়ে গেছি… উনি আমাকে বুঝালেন মা-বাবাকে হাগ দেয়া বা আলিঙ্গন করা আমাদের কালচার না, বা আমাদের ধর্ম এটা এলাউ করেনা। হাসব্যান্ড উয়াইফ ছাড়া কেউ কাউকে আলিঙ্গন করতে পারেনা বা উচিতনা… আমি আসলে কখনই সচেতনভাবে কট্ট্রর মানুষদের সাথে কোন তর্কে যাইনা। সবচেয়ে বড় কথা আমি আমার মনের শান্তি নিয়ে চলি এবং আমার কাছে সবার আগে এটা… তবে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।  

আরেক পরিচিত বাসায় গেছি, একজন চেনা মাঝ বয়েসি ভদ্রমহিলাকে চিনতাম। খুব সুন্দর করে শাড়ী পরতেন। রান্না করার সময় গুণগুণ করে গান গাইতেন, মাঝে মাঝে হালকা সাজগোজ করতেন এবং তা ছিল যথেষ্টই রুচিশীল। সেই আন্টিকে জড়িয়ে ধরে ছবি উঠাতে গেছি উনি আঁতকে উঠে সরে গেলেন, আমাকে বললেন এখন আর উনি ছবি উঠাননা, গান শুনেননা… শাড়ী পরেননা, এগুলো উনার ধর্মচর্চারই প্রকাশ বুঝে আমি নিজেকে নিবৃত্ত করি!!!  

ধানমন্ডি বেশ কিছু রেস্টুরান্টে খেতে গিয়ে  দেখেছি পুরোপুরি ওয়েস্টার্ন আউটফিটের দুর্দান্ত সব চৌকস মেয়ের দল বসে আড্ডা দিচ্ছে। রাস্তায় সাইকেল স্কুটি চালাচ্ছে, কিশোরী, তরুণী মেয়েরা। সুপার শপে প্রচুর মেয়ে কাজ করছে… এবং অনেক রাত পর্যন্তও।  

আমি আসলে জানিনা, কোনটা বাংলাদেশ, মানে আজ থেকে অর্ধযুগ বা এক যুগ পর এইরকম গুবলেট বাংলাদেশ নিয়ে আমরা ঠিক কোন জায়গাটায় দাঁড়াবো কে জানে!!!  

চাওয়া একটাই প্রাণের বাংলাদেশ, ভালোবাসার বাংলাদেশ ভালো থাকুক!!!  

ভালো থাকুক, সুন্দর আর সহজ সরল থাকুক এই বাংলার মানুষেরা মিলেমিশে একাকার হয়ে হাতে রেখে হাত। ধর্মচর্চার নামে কোন বিভাজন যেন আমাদের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্যে হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়।  

দেশ মানে সবার স্বাচ্ছন্দে পথ চলা, নির্ভয়ে এগিয়ে যাওয়া, হাতে রেখে হাত… এই বিশ্বাস আমি রাখতেই চাইবো আমৃত্যু!!! 

ধন্যবাদ অশেষ, যে আপনি সময় নিয়ে পড়লেন, বেঁচে থাকলে ফিরবো নুতন লেখা নিয়ে!!!  

নাদেরা সুলতানা নদী
কলামিস্ট/সংস্কৃতি কর্মী
উপস্থাপক, বাংলা রেডিও
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা

 

 

লেখিকার অন্যান্য লেখা গুলির জন্য ক্লিক করুন :

প্রবাসীর চোখে বাংলাদেশ ২০১৯  – পর্ব ৩

প্রবাসীর বাংলাদেশ ২০১৯  – পর্ব ২

প্রবাসীর বাংলাদেশ ২০১৯  – পর্ব ১

সামাজিক কোন আড্ডায় আপনি কী বলেন…!!!

পরবাসী জীবন একান্ত অনুভব ২

পরবাসী জীবন, কিছু একান্ত অনুভব!!!