প্রবাসীর বাংলাদেশ ২০১৯  – পর্ব ২

প্রবাসীর বাংলাদেশ ২০১৯  – পর্ব ২

বছরের শুরুতেই ঘুরে এলাম বাংলাদেশ। ৭ জানুয়ারী ১৯ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯, পাঁচ সপ্তাহ। সিডনী বাঙালি পাঠকদের সাথে শেয়ার করছিলাম সেই সফরের অল্প বিস্তর।

আজ বাংলাদেশের খাবার দাবার নিয়ে কিছু বলি…

বাংলাদেশের আমার যা কিছু খুব প্রিয় প্রিয় এবং ভীষণ মিস করি তার একটা হচ্ছে কুয়াশা, শীতের দিনের কুয়াশা। শীতের সকালের কুয়াশা ভেজা মাঠ, কবিতায় যেমন পড়ি, ‘’একটি ঘাসের ডগায়, একটি শিশির বিন্দু’’ সেই শিশির বিন্দু যেমন প্রিয়, তারচেয়ে খুব বেশীই প্রিয় আমার কুয়াশামোড়া সন্ধ্যা।

ময়মনসিংহের মেয়ে আমি। গুলকী বাড়ি ছিলাম স্কুল কলেজের বেশ লম্বা সময়। শীত আসি আসি সন্ধ্যাগুলোতে প্রায়ই আমার মা, ছোট ভাই, বোন, আমার খালা, মামা বা  কাজিন, পাড়ার কিছু সিনিয়র জুনিয়র আপা,  বা বান্ধবী মিলে  হাঁটতে যেতাম সেই সার্কিট হাউজ মাঠ হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে। তখন কিশোর ক্লাসিক পড়ি, সেবা প্রকাশনীর সেবা রোমান্টিকগুলোও পড়া হয়। কোন এক রোমান্টিক বইতে একটা পাইন বনের অদ্ভুত সুন্দর বর্ণনা ছিল এবং ছিলো কুয়াশা। সম্ভবত নায়কের সাথে নায়িকার দেখা হয় এমন কোন কুয়াশা সন্ধ্যায়ই। সেই থেকে কিনা জানিনা কুয়াশা ঢুঁকে গেছে মাথায়।

কোন কোন বিকেল ছোঁয়া সন্ধ্যায় সবার সাথে হাঁটতে গিয়ে, ফেরার পথে সার্কিট হাউস মাঠেই দলছুট হয়ে সামনে চলে যেতাম। আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছেনা, আমি হারিয়ে গেছি, কিন্তু হারাইনি… এ এক আপার্থিব সুখ সুখ অনুভূতি। হয়তো কারো সাথে মিলবে না, আবার মিলেও যেতে পারে। কারো মাথায় এমন অনুভূতি না থাকলে বোধ হয় আমি এটা বুঝতে পারবোনা কেমন  সুখ!

তবে বাংলাদেশ ট্যুর নিয়ে বলতে গিয়ে এই আবেগীয় স্মৃতি চারণ কেন? না আরো একটু খুলেই বলি। আসলে কুয়াশা আমার আরো একটা কারণে প্রিয়। একদম ছোট বেলায় ওভাবে সবজী খেতামনা। স্কুল লাইফের অনেকটাই হোস্টেলে কেটে গেছে। কলেজে পড়ার সময়ই আসলে ময়মনসিংহে বাসা ভাড়া করে থাকা বছর দুই ময়মনসিংহ শহরে সেই বাসায়।

সেই সময় আমার মা আমাদের গ্রামের বাড়ীতে লাউ, পুঁই শাক, শালগম, টমেটো, ধনে পাতা (বিলেতী)  সিম এমন কিছু শীতের সবজি করেছিলো এবং ফলন হয়েছিলো বাম্পার যাকে বলে। বস্তা ভর্তি সবজি চলে আসে গ্রাম থেকে। আম্মা আবার সেই সবজী দিয়েই সবজী করে,  প্রতি বেলায়, ভাজি বা নিরামিষ বলতে যা বুঝায় তাই রান্না করতো। এবং মজার ব্যপার হচ্ছে সেইসব রান্না বছর দুই পর যখন জীবন থেকে উঠে গেল, মানে ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে এবার গন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হল জীবনে। তখনই বুঝতে পারলাম, হায় কী হারালাম।

রোকেয়া হলে থাকা পুরোটা সময় তাই, হলের ভিতরেই যা সবজী কিনতে পাওয়া যেত তাই দিয়ে যা ইচ্ছে তাই রান্না করে ফেলতাম। আসলে তো মনে মনে যা মিস করতাম তা  পুরনের ব্যর্থ চেষ্টা।

হল জীবন শেষ করে সংসার জীবন। বিয়ের ৪/৫ মাস পরই চাকরীতে ঢুঁকে যাই। সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ৮/৯ টায় বের হয়ে রাত প্রায় ৭/৮ টায় ফিরতে হতো সেই অফিস করা দিনগুলোতে। আরাম করে বাসায় খাওয়া বলতে রাতে আর সপ্তাহের ডে অফ শুক্রবারে। মাঝে মাঝে নিজেই বাসার আসে পাশে বসা সবজি দোকানে যেয়ে দেখে দেখে কিছু কিনে নিয়ে আসতাম। সেই রকম করে সবজি খাবো বলে…

এই রকম লাইফ স্টাইলের মাঝেই ২০০৯ এ হয়ে যাই পরবাসী। শুরুতে এডেলেড, সাউথ অস্ট্রেলিয়া ছিলাম। এই সময়ে অস্ট্রেলিয়াতে যেমন প্রচুর এশিয়ান গ্রোসারী এবং বাংলাদেশের  এমন কিছু  সবজী পাওয়া যায়, সেই সময়ে এমন ছিলনা। এডেলেডে লম্বা সময় অনেক রকমের সবজি মিস করেছি। দুই একটা দোকান থাকলেও সময় করে যাওয়া হতোনা। বাধ্য হয়ে অস্ট্রেলিয়ান সুপার শপে যা যা পাওয়া যায় তাতেই অভস্ত্য হয়েছি।

এবং এখানে এসে ফুল কপি, বাঁধা কপি, বেগুন খেতে যেয়েই আমি প্রথম আবিষ্কার করলাম, সেই যে স্কুলের দিনগুলোতে এই সবজিগুলো বিশেষ করে শীত এলে খেতাম যে স্বাদ মুখে লেগে আছে সেইরকমটা এগুলোতে নেই। শুধু শীতের কুয়াশা ভেজা সবজির যে মজা এটা আমরাই জানি বোধ হয়!!!

নিজের অজান্তেই আমার একটা প্রিয় ফ্যান্টাসির নাম হয়ে গেল, ‘’কুয়াশা’’!!!

বাংলাদেশ আসলে অনেকদিন থেকেই একবার ভরা শীতেই যেতে চাইছিলাম। সেটাই হয়ে উঠছিলোনা। হলোনা এবারও।  এমনিতেই সব সিজনেরই চরিত্র গেছে বদলে। আর এখন জানুয়ারীতেই তেমন শীত আর বাংলাদেশের সব জায়গায় থাকেনা। কুয়াশাও তো নাকি সব জায়গায় পড়েনা। তবে সবজীর ব্যাপারটা আমি ঠিক ধরতে পারলামনা। যখনই কোন সব্জির দোকান চোখে পড়েছে, আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে সৌন্দর্য দেখে।  আলু, বেগুন, সীম, লাউ, বাঁধা কপি, ফুল কপি, পালং শাক, পুঁই শাক এবং কত রকমের শাক। সবই তরতাজা। আমার অতিরিক্ত সবজিপ্রীতির এই  চোখে এতো সহজে ভেজাল ধরতে পারার কথা না।  আমরা যেমন শুনি, ভেজালে ভরপুর সব…

শুরুতে ঢাকায় শ্বশুর বাড়ী যেয়ে উঠা… অনেক বছর পর গেলে যা হয়। পুরো সময়টাই ভি ভি আই পি ট্রিটমেন্ট। আমার ছোট মাছ ও সবজি প্রীতি পরিবারের সবার জানা … স্বাভাবিকভাবেই ডে ওয়ান থেকেই টেবিলে এই সবই পেয়েছি। সকালে বাসায় সাহায্য করা মেয়েটা  যখন হাতে বানানো কয়টা রুটি আর সবজী দিয়ে বলতো মামী আসেন নাস্তা করেন… আহ এ সুখের যেন নেই তুলনা। বাসায় থাকা সবাই এক রকমের সবজি খেতে খেতে নাকি হয়রান। মানে দিনের পর দিন একজনের রান্না একই স্টাইল। কিন্তু আমার তো উল্টো নিজের রান্না আর কত, গত ৯/১০ বছর ধরে টানা খাচ্ছি, তাই সাময়িক এই রিলিফটাও বেশ  এঞ্জয় করি।

মেয়েটার নাম মর্জিনা, আগের রাতেই জিজ্ঞেস করে রাখতো, সকালে কি ভাজি চাই। আমি তো পারলে ওকে বলি, প্রতিদিন সীম, ছোট আলু দিয়ে, বা ফুলকপি, সিম, নুতন ধনে পাতা দিয়ে, বাঁধা কপি ভাজি তো পারলে প্রতিদিনই খাওয়া যায়… ওকে বলি, যা দেবে তাই খাবো, সব পছন্দ আমার। ও ওর নিজের পছন্দেই করে দিতো, এক আধ দিন  হয়তো ভাজি ভালো হতোনা, আমি তৃপ্তি করেই খেয়ে নিতাম, তবে একটাই সমস্যা ওর হাতের চা টা তেমন ভালো হতোনা.. আমি সুগার ফ্রি খাই, ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া এক প্যাকেট দিয়ে বলেছি আমার চায়ে ওটা দিতে। কদিন যাওয়ার পর আবিষ্কার করলাম শে আমার চা আরো মজার করার জন্যে দুইটা প্যাকেট মিশিয়ে দেয় !!!

ঢাকায় মাছের বাজারে যারা মানে এক্সপার্ট তাঁদের কারো না কারো সাথে সম্পর্ক ভালো থাকেই। মানে মাছ বিক্রেতা। আমার শ্বাশুরী মায়েরও আছে। সেই সুবাদে, ঢাকায় নেমে প্রিয় প্রায় সব মাছই খাওয়া হয়ে গেছে এবং রীতিমত সব ফ্রেস। মিশালী মাছ, সরপুটি, কাজলী, বোয়াল, আইড়, রুই, কাতলা, মাগুর, বাতাসী, চিতল, কই, পাবদা, ইলিশ… কি খাইনি।

শুরু থেকেই এবার খুব চেয়েছি বাসার খাবারই খেতে, দাওয়াতের বাইরে। রেস্টুরান্ট আমাকে খুব টানেনা আসলে। শুধু বন্ধুদের জন্যেই যাওয়া। এবং জ্যামের জন্যে শুধু আমার নিবাস থেকে কাছাকাছি  দুই একটা ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট ছাড়া সাহসও পাইনি আসলে যাওয়ার।

তবে বেশীর ভাগ বাসায় দাওয়াত খেতে যেয়ে যেটা চমকৃত হলাম। বাংলাদেশে এখন দেশীয় সবজীর পাশাপাশি  বিদেশের অনেক সবজীও পাওয়া যায়। আমার দেখা ঢাকা এবং বাংলাদেশ বলা যায় সেই ২০০৯ এ এসে আঁটকে আছে। ঐ সময়ের পর দুই একবার যেয়ে  আসলে সব বদলে যাওয়াগুলো একবারেই দেখা সম্ভব হয়ে উঠেনা। তারপরও এটা বুঝি … কতটা হলো পরিবর্তন।  আমার সব আত্মীয় এবং বন্ধুদের রান্না পরিবেশনা দেখে বুঝেছি বাংলাদেশে ফুড কালচার এখন আরো বেশী উন্নত এবং সুস্বাদু হয়েছে, বলাই বাহুল্য!!!

ব্রকলি, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরীর মত সবজী, ফ্রটস এখন পাওয়া যায়। এবং এই অস্টেলিয়াতে যেমন সারা বছর সব সবজী পাওয়া যায়, বাংলাদেশেও তাই। তবে কিছু সবজী বোধ হয় ব্যতিক্রম। এই যেমন পটল, ঝিঙ্গে, কাকরোল এগুলো খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো, পেলামনা… সিজন না বলেই হয়তো।

নিঃসন্দেহে দামের বিষয়টা আকাশ পাতাল পার্থক্য। আমার মনে আছে ২০০৯ এ দেশ ছাড়ার আগে আমি মাঝে মাঝে সব মিলিয়ে এই ১০০ টাকার সবজি কিনতাম যা প্রায় পুরো সপ্তাহ জুড়ে খেতাম। এখন ১০০ টাকায় এক/দু আঁটি  শাক পাওয়া যায়, তবে সব শাক না।

ও যাঁদের জানা নেই তাঁদের বলি, বাংলাদেশে অনেক রকম নুতন শাক পাওয়া যায় এখন। আমি নিজেই বেশ ক’রকম নুতন শাক খেলাম, তার মাঝে একটা শাক বেশ মজার, নাম নাপা।

ঢাকার অলি গলিতে হয়েছে প্রচুর ক্যাফে এবং রেস্টূরান্ট…  আমি যে বাসায়ই দাওয়াতে গেছি বাসার কাছেই আছে বেশ কয়েকটি কেক এর দোকান, একটা করে কেক নিয়েই গেছি বেশির ভাগ বাসায়। সেই কেকও রীতিমত মজা (আমি কেক লাভার নই যদিও)। খাবার পরিবেশনায় ক্যাফেগুলো চমক রাখে…  ক্যাফেতে কাজ করে বেশ স্মার্ট সব ছেলে মেয়ে। মেয়েদের মাঝে অনেক হিজাব করা মেয়ে কড়া মেকাপ নিয়ে কাজ করছে, যা লক্ষনীয়।

গ্লোরিয়া জিনসের মত কফি শপে বসে কফি আর সাথে অল্প কিছু খেলেই যে বিল আসে সেটা অবশ্য আপনি অনেকদিন পর বাংলাদেশ গেলে শকড হবেন নিঃসন্দেহে, আমি হয়েছি।

বনানীতে নুতন হয়েছে টাগোর পেলেস, যাওয়া হয়েছে এক সন্ধ্যায়। চেনা ঝাল মুড়ি, সিঙ্গারা, চা, জুস থেকে অনেক ভ্যারাটিস খাবারই আছে… তবে দাম আমার কাছে বেশী লেগেছে, আমি ভুল হতে পারি, আইডিয়া নেই আমার হয়তো অন্য সব রেস্টুরান্টের। না এটা ঢাকায় থাকা অনেকের কাছে হয়তো একদমই বেশী না। আমরা যারা লিমিটেড আয় করি এবং অল্প বাজেট নিয়ে দেশে বেড়াতে যাই তাঁদের জন্যেই হতে পারে আর কী।

প্রচুর লোকজন বাইরে খেতে আসে দল বেঁধে পরিবার বন্ধু নিয়ে। মেয়ে বন্ধুরা কেউ কেউ আসে, প্রাণ খুলে আড্ডা দেয়  এবং স্মোকিং কর্ণারে বসে দূর্দান্ত স্মার্টলি স্মোক করে।

আমার বন্ধুরা প্রায় সবাই অনেক ভালো জব করছে, সবার লাইফ পার্টনারও তাই, গাড়ী আছে প্রায় সবার… মধ্যম আয়ের দেশ বলে কথা। এক সময় যে আমরা ভাবতাম শুধু বড়লোকেদেরই গাড়ী বাংলাদেশে এখন আর এই বাস্তবতা নেই আসলে…

তবে, কিছু শুভংকরের ফাঁকি তো আছেই, বড় লোকেরা আরো বড় লোক হয়েছে, হচ্ছে। প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করা মানুষদের গত ৫/৭ বছরে বেতন বেড়েছে কয়েক গুণ, বেড়েছে সরকারী চাকরীজীবিদেরও। স্বল্প আয়ের মানুষদের ঢাকায় বসবাসটা কঠিন, যা  নিম্ন আয়ের মানুষদেরও  ওভাবে নয়…

আমার পক্ষে সবকিছুতে আরো বেশী ইনভল্ভ হয়ে দেখা সম্ভব হয়ে উঠেনি… তারপরও আরো যা আছে বলার ফিরছি বেঁচে থাকলে সামনের পর্বে নিয়ে…

যারা পড়লেন, অশেষ ধন্যবাদ।

ভালোবাসার বাংলাদেশ ভালো থাকুক!!!

নাদেরা সুলতানা নদী
কলামিস্ট/সংস্কৃতি কর্মী
উপস্থাপক, বাংলা রেডিও
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা

 

লেখিকার অন্যান্য লেখা গুলির জন্য ক্লিক করুন :

প্রবাসীর বাংলাদেশ ২০১৯  – পর্ব ১

সামাজিক কোন আড্ডায় আপনি কী বলেন…!!!

পরবাসী জীবন একান্ত অনুভব ২

পরবাসী জীবন, কিছু একান্ত অনুভব!!!