মুজিব জন্মশত বার্ষিকীতে বাম-হুজুরদের কী কর্মসূচি?

মুজিব জন্মশত বার্ষিকীতে বাম-হুজুরদের কী কর্মসূচি?

ফজলুল বারী: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করে বাংলাদেশের নানা এলাকায় প্রতিবাদ হচ্ছে। এসব প্রতিবাদ করছে কিছু বামপন্থী দল, বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠন। বামদের প্রতিবাদগুলো ছোট, ডান ধর্মীয় সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ সমাবেশগুলো। বাংলাদেশে মাঝে মাঝে এমন ডান-বাম সব এক স্রোতধারায় মিশে যায়। ডানপন্থীরা মনে বামপন্থীরা নাস্তিক-আল্লাহ-খোদা মানেনা। কিন্তু স্বার্থের স্রোতধারাটি এক হয়ে গেলে আস্তিক-নাস্তিকের সমাবেশগুলো হয় আরাম সমাবেশ! বাম জোনায়েদ সাকি বলেছেন সীমান্ত হত্যা সহ অসম সম্পর্কের কারনে তারা মোদীর সম্পর্কের প্রতিবাদে তারা মোদীর সম্পর্কের বিরোধিতা করছেন! মোদীতো আগে বাংলাদেশে এসেছেন। এসব ইস্যুতে তখন কী প্রতিবাদ করেছেন? বাংলাদেশের জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীতে আপনাদের কর্মসূচি কী জনাব বাম জোনায়েদ সাকি?
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বাংলাদেশে দাওয়াত করা হয়েছে মুজিব জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতির পিতা। তাঁর নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাঁর কারনে। একশত বছর আগে হাজার বছরের এই শ্রেষ্ঠ বাঙালি জন্মেছিলেন বলেই দেশে-বিদেশে আজ আমরা গর্বিত বাংলাদেশি। নরেন্দ্র মোদীর সফরের বিরোধিতা যারা করছেন তাদের এখন ধরে ধরে জিজ্ঞেস করতে হবে মুজিব জন্মশত বার্ষিকীতে তাদের কর্মসূচি কী? বাংলাদেশে থাকবেন খাবেন সবকিছু এনজয় করবেন কিন্তু দেশটির জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীতে একটা মিলাদও দেবেননা এটা কি করে হয়! পাকিস্তানে থাকতেতো হৃদয় দিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে জাতির পিতা জাতির পিতা করতেন। এখন বঙ্গবন্ধুতে অরূচি কেনো তা একটু সাফ সাফ বলতে হবে। নরেন্দ্র মোদী ভারতের বিজেপির নেতা। কিন্তু কংগ্রেস নেতা মোহন চাঁদ করম চাঁদ গান্ধীকে জাতির পিতা হিসাবেই তারা শ্রদ্ধা করেন। জাতির পিতা নিয়ে কারও কোথাও সূচিবায়ুগ্রস্ত থাকতে নেই। এই সুযোগে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোল ডিসেম্বর কে কিভাবে পার করেন এর বিস্তারিত জানতে হবে।
নরেন্দ্র মোদীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মুজিব জন্মশত বার্ষিকীতে দাওয়াত করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী কোন সুফি সাধক নন। বাংলাদেশে যেমন মুসলমান মৌলবাদীরা তাঁর সফরের বিরোধিতা করছেন, মোদীও ভারতের হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন বিজেপির নেতা। মোদীর সঙ্গে এক জায়গায় তাঁর বাংলাদেশি বিরোধীদের তফাৎ। তাহলো বাংলাদেশের এখনকার মোদী বিরোধিরা ভোটে ডাব্বা মারেন। মোদী জেতেন ভোটে। তাঁর যোগ্যতা-ক্ষমতা ঠিক করে গণতন্ত্র। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের নির্বাচনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী। একবার নয়, পরপর দু’বার নির্বাচনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ সরকার ভারতের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রন জানিয়েছে। এই আমন্ত্রন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীই পেতে পারেন। কারন বাংলাদেশ ভারতের সর্বাত্মক সহায়তায় স্বাধীন হয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তানি গণহত্যার সেই সময়ে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে তাদের প্রান বাঁচিয়েছে ভারত। আর এখনও যদি এই বিরোধিতার পিছনে পাকিস্তানি হৃদয়ের কান্না কাজ করে সে কাহিনীও দেশের মানুষকে জানতে হবে।
মুজিব জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রনের সঙ্গে দিল্লীর ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই। যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে দাওয়াত করা হয় তখন দিল্লীর ঘটনা ঘটেনি। দিল্লীর ঘটনা ঘৃণ্য, নিন্দনীয়। আমরা সবাই সেই ঘটনার নিন্দা করেছি। নিন্দা করে যাবো। কিন্তু দিল্লীর ঘটনার পর প্রতিবাদ হিসাবে বাংলাদেশের কেউ ভারতে যাওয়া বন্ধ করিনি। প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ লক্ষ বাংলাদেশি বৈধপথে ভারতে যান। এত বাংলাদেশিকে ভিসা দিতে নানা ব্যবস্থাপনা গড়েও ভারতীয়দের হিমসিম খেতে হয়। বাংলাদেশের লোক আজমির জিয়ারত, চিকিৎসা, বিয়ের বাজার সহ নানা বাহানায় ভারতে যায়। বিয়ার খেতে ক্যাসিনো খেলতেও অনেকে যান ভারতে। কলকাতা-দিল্লীগামী ট্রেন-বাস-বিমানের ৯৯ ভাগ যাত্রী বাংলাদেশি। এমনকি হেফাজতের আমিরের চিকিৎসাও ভারতে হয়। এভাবে এত বাংলাদেশি প্রতি বছর বৈধ-অবৈধপথে কী পরিমান ডলার নিয়ে যান ভারতে এর কোন লেখাঝোখা নেই। দিল্লীর ঘটনার পর এসব নানা বাহানায় ভারতে ডলার নিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়েছে? দেশের স্বার্থ-দিল্লীর নির্যাতিত মুসলমানদের স্বার্থে এমন একটা প্রতিবাদী সিদ্ধান্ত কী কেউ নিয়েছে? ফরজের খবর নেই নফল নিয়ে এই মতলবি প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশ্যটা কী?
মতলবী অনেকে বলছেন মৌলবাদী মোদীকে দাওয়াত না দিয়ে বাংলাদেশ প্রনব মূখার্জি, সোনিয়া গান্ধী বা অন্য কাউকে দাওয়াত করতে পারতো! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে সময় কাঁটানো ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, মোদীকে দাওয়াত করায় বঙ্গবন্ধু নাকি কবরে বসে কাঁদছেন! ধর্ম বিশ্বাসীরা বলেন একজন মানুষ মরে গেলে তার আর করার কিছু থাকেনা। আর জাফরউল্লাহ চৌধুরী নতুন কবর বিশারদ হয়ে গেলেন যে বঙ্গবন্ধু কবরে হাসছেন না কাঁদছেন, তাও বলতে পারেন! আসলে এদের ধান্ধা অন্য জায়গায়। বাংলাদেশ দাওয়াত করেছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁর সফর বিধ্নিত করে এরা ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে চায়। আপনি আমি পছন্দ করি বা না করি ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। এখন আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পছন্দ করিনা বলে বাংলাদেশ কী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে? বাংলাদেশকে কি পাগলে পেয়েছে?
কাজেই যারা এখন আসল বাদ দিয়ে নফল নিয়ে ব্যস্ত তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে মুজিব জন্মশত বার্ষিকীতে তাদের কর্মসূচি কী। শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে কটাক্ষ করে বলেছেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে কোন উৎসব সফল হবেনা! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকীর সঙ্গে দুর্নীতির মামলায় দন্ড নিয়ে কারাগারে থাকা খালেদা জিয়ার সম্পর্ক কী? না খালেদা জিয়া মুক্ত থাকলে মুজিব জন্মশত বার্ষিকী সফল করার কর্মসূচি নিতেন! একই বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে খালেদা জিয়া স্বাধীনতার জন্যে কারাগারে ছিলেন পাকিস্তানিদের হাতে!’
বিএনপির এই নেতা কেনো খালেদা জিয়ার একাত্তরের এসব স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে খামোখা ঘাটাঘাটি করেন! এভাবে খালেদা জিয়ার ইজ্জত বাড়বে? না তাকে নিয়ে অন্য বিতর্কের সৃষ্টি হবে? একাত্তর সালে খালেদা জিয়া ছিলেন একজন মেজরের স্ত্রী। ছোট দুই বাচ্চার মা। রাজনীতির সাতেপাঁচে ছিলেননা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করলে হয়তো সেই সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া জিয়া খালেদা জিয়াকে তার কাছে নিয়ে যেতে জেড ফোর্সের সাহসী এক সৈনিক হাবিবুর রহমান সানীকে আগরতলা থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল জিয়ার হাতে লেখা চিঠি। একাত্তরের ওই সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনানিবাসে খালেদা জিয়ার কাছে পৌঁছেছিলেন।
কিন্তু জিয়ার চিঠি পেয়েও মুক্তিযোদ্ধা সানীর সঙ্গে তিনি ভারতে যাননি। একাত্তরের মে মাসে পাকিস্তানিরা খালেদা জিয়াকে দিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করায়। সেখানে তিনি যুদ্ধে যাওয়া তার স্বামীকে পাকিস্তানিদের পক্ষে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছিলেন! এরজন্য স্বাধীনতার পর জিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। খালেদা জিয়া বত্রিশ নাম্বার বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে সহায়তা চান। আর মির্জা ফখরুল বলছেন খালেদা জিয়া কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে! বাংলাদেশের যারা রাজনীতি করবেন, মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতির জনক প্রশ্নে সব ধরনের স্ববিরোধিতা বন্ধ করতে হবে। ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস। মুসলমানরা সেখানকার অন্যতম লড়াকু সম্প্রদায়। ভারতের মুসলমানরা সে দেশের রাষ্ট্রপতিও হয়। সেখানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশটির সিভিল সোসাইটি সোচ্চার। অতএব ভারত নিয়ে কান্না না করে বলুন মুজিব জন্মশত বার্ষিকীতে আপনাদের কার কী কর্মসূচি?